আজকের আলোচনার বিষয়ঃ ওগো বাঁশিওয়ালা। রবিশঙ্কর মৈত্রীর জন্ম ১৯৬৯ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। বাবা ঋত্বিক কুমুদরঞ্জন, মা জয়ন্তী দেবী । পৈত্রিকনিবাস ফরিদপুর জেলার মধুখালি উপজেলার নরকোণা গ্রামে। শৈশব থেকেই লেখালেখি শুরু। প্রথম কবিতা লেখা এবং সম্পাদনা দেয়াল পত্রিকায় প্রথম প্রকাশ, মাসিক সন্দীপনা পত্রিকায়, এরপর জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিকে ছােটোগল্প প্রবন্ধ প্রকাশিত।
ওগো বাঁশিওয়ালা । রবিশঙ্কর মৈত্রী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কণিকা’ কাব্যে আদিরহস্য শিরানামে লিখেছেন-
বাঁশি বলে, মোর কিছু নাহিকো গৌরবে,
কেবল ফুঁয়ের জোরে মোর কলরব।
ফুঁ কহিল, আমি ফাঁকি, শুধু হাওয়াখানি-
যে জন বাজায় তারে কেহ নাহি জানি।
বাঁশি নিয়ে এমন সুস্পষ্ট কথা আর কী হতে পারে? রবীন্দ্রনাথের কথার সূত্র ধরেই বলি, আমরা বাঁশি শুনি, কিন্তু বাঁশিওয়ালাকে বুঝি না। বাঁশিওয়ালা, যে তাঁর সমস্ত নৈপুণ্য দিয়ে একটা ছিদ্রকে বাঁশি করে তোলেন, শ্রোতাকে নিয়ে যান অতীন্দ্রিয় জগতে, সেই বাঁশিওয়ালাকে খুব একটা জানা হয় না।
বাঁশির আওয়াজ আমাদেরকে ভীষণ টানে, সংসারের অনেককিছুকে ভুলিয়ে দেয়। বাঁশি যেন সবার মনের কথা বোঝে। কিন্তু আমরা শ্রোতারা কি বাঁশি আর বাঁশিওয়ালার রহস্য বুঝি?
অপার রহস্যময় মাদকতাময় এক যন্ত্রের নাম বাঁশি। বাঁশি যেহেতু মুখ দিয়ে বাজানো হয়, তাই বুঝি তার ভাষা থাকে আমাদের মুখের ভাষার খুব কাছাকাছি। বাঁশিতে প্রতিটি কথা ফুটে ওঠে সুরে সুরে বাঁশি যেন হৃদয়ের গভীর থেকে তাঁর অন্তর্বেদনা তুলে আনে- আর এসবই ঘটে বাঁশিওয়ালার ফুঁ আর তাঁর আঙুলের যাদুমন্ত্রে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর কড়ি ও কোমল কাব্যে বাঁশি কবিতায় বলেন-
ওগো, শোনো কে বাজায়!
বনফুলের মালার গন্ধ বাঁশির তানে মিশে যায়।
অধর ছুঁয়ে ধাপিখানি চুরি করে হাসিখানি,
বঁধুর হাসি মধুর গানে প্রাণের পানে ভেসে যায়
ওগো শোনো কে বাজায়!
কুঞ্জবনের ভ্রমর বুঝি বাঁশির মাঝে গুঞ্জরে,
বকুলগুলি আকুল হলে বাঁশির গানে মুগ্ধরে ।
যমুনারই কলতান কানে আসে, কাঁদে প্রাণ,
আকাশে ওই মধুর বিধু কাহার পানে হেসে চায়!
ওগো শোনো কে বাজায়।
আমার আবৃত্তির সুরে যে বাঁশিওয়ালা একদিন তাঁর হৃদয়কে বাজিয়ে বিস্মিত করেছিলেন। তিনি উত্তম চক্রবর্তী। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে আমি তাঁর কাছাকাছি আছি, আছি তাঁর বাঁশির সঙ্গে উত্তমের খুব কাছে থেকেও তাঁর বাঁশির রহস্য-বিস্ময় আমার কাটেনি। দিনে দিনে তাঁর ওপর আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা আরো বেড়েছে।
উত্তম চক্রবর্তী একাধারে অনেককিছু। উত্তমের মধ্যে আছে লেখকসত্তা। তাঁর ঝরঝরে গদ্য পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। উপন্যাস আর ভ্রমণসাহিত্যে এরই মধ্যে উত্তম চক্রবর্তী জায়গা করে নিয়েছেন।
সর্বোপরি উত্তম চক্রবর্তী একজন বাঁশিবাদক। তিনি বাঁশিতে কেবল সুর তোলেন না। তাঁর বাঁশিতে ফুটে ওঠে সুখ-দুঃখময় বিচিত্র জীবনের বর্ণিল অনুভব।
উত্তম যেহেতু সাহিত্যের মানুষ, তাই তাঁর বাঁশি যেন কথা বলে। নাটকে ও কবিতায় তিনি যথোপযুক্ত আবহ তৈরি করেন। একটি কবিতা শুনে কবিতার ভাব বুঝে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তাঁর বাঁশিতে রচনা করতে পারেন নতুন কোনো সুর। উত্তম চক্রবর্তীর মতো অনুভূতিপ্রবণ বাঁশিবাদকের সাক্ষাৎ পাইনি।
আমি উচ্চাঙ্গ সংগীত তেমন একটা বুঝি না, মাঝে মাঝে কেবল অনুভব করার চেষ্টা করি। বাঁশিতে কেমন করে কতভাবে রাগের বিস্তার ঘটানো সম্ভব আমার জানা ছিল না। উত্তমের কাছাকাছি থেকে তাঁর বাঁশির সেই ঐশ্বর্যপূর্ণ সৌন্দর্যের সাক্ষাৎ পেলাম ।
আরও দেখুনঃ