তত্ত্বমূলক সংগীত

আজকে আমরা তত্ত্বমূলক সংগীত সম্পর্কে আলোচনা করবো। যে চিত্তাকর্ষক ললিতকলার সাহায্যে শিল্পী তাঁর হৃদয়ের নিগূঢ় ভাবসমূহ সুর ও লয়ের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করেন, তাকেই বলা হয় সংগীত। সংগীত ৩ প্রকার। গীত বা কণ্ঠসংগীত, বাদ্য এবং নৃত্য।

 

তত্ত্বমূলক সংগীত

 

তত্ত্বমূলক সংগীত

এই উপমহাদেশীয় উচ্চাঙ্গ সংগীত খুবই প্রাচীন। ফলে এর আকার ও প্রকার বহু বিচিত্র সুপ্রাচীন ইতিহাস থেকে এরূপ অনুমিত হয় যে, কোনো এক সময়ে সংগীত সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। এঁরা ছিলেন আসলে আধ্যাত্মসাধক। গুহ্যসংগীতের মধ্য দিয়ে তাঁরা ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিতেন এবং তাঁদের অনুগামী ভক্তদের মুক্তি ও পরিত্রাণের পথ দেখিয়ে দিতেন। এই সংগীতকে বলা হয় “গান্ধর্ব” বা মার্গ সংগীত। কারণ এই সংগীত বিশ্বপ্রকৃতির মূল উৎস শাশ্বত ও সনাতন “বাকব্রহ্মের” মৌলিক বিধানাবলির ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছিল।

মুসলমান সম্রাটগণের রাজসভা কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংগীতজ্ঞগণ কর্তৃক অলংকৃত ছিল বলে আমরা দেখতে পাই। আমীর খসরু নায়ক গোপাল সমসাময়িক কালের ইতিহাসকে তাঁদের অনুপম ও অনবদ্য সংগীত সাধনার মধ্য দিয়ে অমর করে রেখেছেন। সম্রাট আকবরের কাল থেকে স্বনামধন্য (পূর্ব নাম রামতনু পাড়ে) থেকে শুরু করে আমাদের একালের নামকরা ওস্তাদগণ এই উচ্চাঙ্গ সংগীতের ঐতিহ্য ও ধারক-বাহক। একথা নিঃন্দেহে বলা যায় যে, “এই উপমহাদেশের সংগীত মধ্যযুগের হিন্দু-মুসলমানী কৃষ্টি ও সংস্কৃতির অনুপম সংমিশ্রণের একটি মহান কীর্তিস্তস্বরূপ। ”

অতঃপর সংগীতে কবি তুলসীদাস, সুরদাস ও অপরাপর শিল্পীদের যুগ অদ্যাবধি এঁরা সংগীত ক্ষেত্রে অমর ও অপারাজেয়।

 

google news
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

বাঁশি বা বাঁশরির আবিষ্কার:

বাঁশি অত্যন্ত পুরাতন বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে অন্যতম যা বাঁশরি নামে 1 খ্যাত। খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ থেকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে এখনও প্রচলিত আছে। দ্বাপর যুগের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণের হাতে বাঁশি ছিল। তিনি বাঁশি বাজিয়ে লীলা করতেন। তাই বাঁশির স্রষ্টা হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকেই মানা হয়। আমাদের এই উপমহাদেশে বাঁশিতে ক্লাসিক্যাল এর জনক হিসেবে বরিশালের পান্নালাল ঘোষকে মানা হয়।

 

সংগীতের সৃষ্টি:

আগে মুনি-ঋষিরা ‘নাদের’ উপাসনা করতেন। সাধক ঋষিরা পশু-পক্ষীর কন্ঠস্বর থেকে স্বর ও ধ্বনি নিয়ে তাকে Refine করে সংগীত উপযোগী করে শ্রুতিমধুর অংশগুলোকে সংগীতে ব্যবহার করেছেন। তাঁরা সংগীতের মাধ্যমে ঈশ্বরের সাধনা করতেন। এই মুনি-ঋষিরাই অনেক সাধনা করে ‘নাদ’ থেকে সংগীতের উপযোগী ধ্বনিগুলো আবিষ্কার করেছেন এবং সংগীত সৃষ্টি করেছেন।

 

সংগীতের স্বর:

প্রাচীনকালে সাধক ঋষিরা পশু-পক্ষীর কন্ঠস্বর থেকে স্বর ও ধ্বনি ব্যবহার করেছেন। যেমন সা = এই ষড় ময়ূরের কন্ঠস্বর হতে নেওয়া হয়েছে রে চাতকের কন্ঠ হতে নেওয়া হয়েছে। গা = মেঘের কণ্ঠস্বর হতে নেওয়া হয়েছে। মা = সংগীতে একে মাধ্যম বলা হয়। এই স্বরটি কাকের কন্ঠস্বর হতে নেওয়া হয়েছে। পা কোকিলের কণ্ঠস্বর হতে নেওয়া হয়েছে। যা = ব্যাঙের কণ্ঠস্বর হতে নেওয়া হয়েছে। নি= হস্তীর কণ্ঠস্বর হতে নেওয়া হয়েছে।

 

নাদ:

কণ্ঠ অথবা যেকোনো ধাতব পদার্থের নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন আঘাত, ঘর্ষণ কিংবা স্পন্দন দ্বারা সৃষ্ট শ্রুতিমধুর আনন্দদায়ক শব্দ আওয়াজকে সংগীতশাস্ত্রে নাদ বলে।

 

তত্ত্বমূলক সংগীত

 

ধ্বনি:

যেকোনো রকমের শব্দ বা আওয়াজকে সংগীতশাস্ত্রে বলা হয় ধ্বনি। ধ্বনিও কণ্ঠ কিংবা যেকোনো ধাতব পদার্থের আঘাত, ঘর্ষণ কিংবা স্পন্দন দ্বারা সৃষ্ট হয় বটে, কিন্তু নাদের মতো এটি শ্রুতিমধুর ও আনন্দদায়ক নয়। কারণ ধ্বনি স্পন্দনসমূহ নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন নয়। সোজা কাথায় নান শ্রুতিমধুর ও আনন্দদায়ক কিন্তু ধ্বনি শ্রুতিকটু ও বিরক্তিকর।

মানুষের কানের গঠন ও শ্রবণক্ষমতা নিতান্ত সীমাবদ্ধ হলেও পূর্বোক্ত স্পন্দনোথিত যেকোনো শব্দ বা আওয়াজ সে ধরতে পারে। মানুষের কানের শ্রবণক্ষমতা নিতান্ত সীমাবদ্ধ বলার কারণ এই যে, একথা সর্বজনবিদিত সত্য যে, ১৬ স্পন্দনের নিচে কিংবা ৪০,০০০ স্পন্দনের মধ্যে সংগীতের সকল প্রকার শব্দ বা আওয়াজ মানবকণ্ঠে শ্রুতি গোচর নয়। প্রকৃতপক্ষে ২৭ থেকে ৪,৫০০ স্পন্দনের মধ্যে সংগীতের সকল প্রকার শব্দ বা আওয়াজ সীমাবদ্ধ। সুতরাং একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, সংগীত প্রধানত ‘নাদের’ ওপর প্রতিষ্ঠিত।

নাদ দুই প্রকার। যথা: (১) আহত নাদ, (২) অনাহত নাদ। কণ্ঠনালি, ওষ্ঠ, জিহ্বা, দন্ত, তালু ইত্যাদির সাহায্যে মানুষের কন্ঠস্বরের যে স্পন্দন সৃষ্টি হয় তাকে বলে আহত বা ব্যক্ত নাদ। কোনো ধাতব বস্তুর আঘাত, ঘর্ষণরত বা স্পন্দন দ্বারা সৃষ্ট শব্দ বা আওয়াজকে বলা হয় অনাহত বা অব্যক্ত নাদ। অর্থাৎ একটি জান্তব অপরটি ধাতব ।

 

শ্রুতি :

নাদ থেকে শ্রুতির উৎপত্তি। নাদ শ্রবণেন্দ্রিয় দ্বারা গ্রহণ বা উপলব্ধি করা যায়। সংগীতোপযোগী প্রত্যেক সুরের সূক্ষ্ম এক একটি বিভাগ যা দ্বারা প্রত্যেকটি একে পৃথকভাবে অপর হতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় তাকে শ্রুতি বলে। আমাদের সংগীতশাস্ত্র মতে সংগীতোপযোগী এক একটি সপ্তকে বাইশটি শ্রুতি আছে। পূর্ব কথিত এ বাইশ প্রকার শ্রুতির মধ্যে সাতটি শুদ্ধ স্বর ও পাঁচটি বিকৃত স্থিরীকৃত স্বর হয়েছে । বাকি দশটি শ্রুতি ঐ সপ্তস্বরে সাধারণত মীড়, আন্দোলন, তান ও গমক ইত্যাদিতে পূর্ণভাবে প্রকাশ পেয়ে থাকে।

শ্রুতি থেকে স্বরের জন্ম। যে নাদের (বা শ্রুতির) ওপর মানব কণ্ঠ সহজে স্থায়ী, পৃথক, স্পষ্ট ও পূর্ণরূপে বিকাশ হয়ে চিত্তের প্রসন্নতা আনে তাকে স্বর বলে। সংগীতে ১২টি স্বরের ব্যবহার হয়ে থাকে। স্বর দুই প্রকার। যথা: শুদ্ধ স্বপ্ন ও বিকৃত স্বর।

 

তত্ত্বমূলক সংগীত

 

তালিকা

শুদ্ধ (বা প্রাকৃত) স্বর ৭টিবিকৃত স্বর ৫টি
প্রচলিত নামসম্পূর্ণ নামপ্রচলিত নামসম্পূর্ণ নাম
সাষড়জঋাকোমল ঋষভ
রে (রা)ঋষভজ্ঞাকোমল গান্ধার
গাগান্ধারক্ষাতীব্র বা কড়ি মধ্যম
মামধ্যমদাকোমল বৈধত
পাপঞ্চমণাকোমল নিষাদ
ধাধৈবত
নি (না)নিষাদ

 

সা ও পা বিকৃত হয় না। তাকে অচল স্বর বলা হয়।

 

তত্ত্বমূলক সংগীত

 

কোমল স্বর:

শুদ্ধ স্বরের কিঞ্চিত নিম্নস্বরকে কোমল স্বর বলা হয়। যথা ঋা জ্ঞা ক্ষা দা ণা

 

তীব্র বা কড়ি স্বর :

শুদ্ধ স্বরের কিঞ্চিত উচ্চ বা চড়া স্বরকে তীব্র বা কড়ি স্বর বলা হয়। যথা ক্ষা

 

সপ্তক:

সা রে গা মা পা ধা নি এ ৭টি শুদ্ধ স্বরের সমষ্টিকে একটি সপ্তক বলে। এ ৭টি স্বর ক্রমান্বয়ে পরপর অবস্থান করলে তাদের সমবেতভাবে অবস্থিতিকে সপ্তক বলে। যেকোনো একটি স্বর থেকে তার অষ্টক পর্যন্ত একটি স্থান বলা হয়। স্বরের উচ্চতা ও নিম্নতা অনুসারে যে ৩টি ক্ষেত্রে প্রস্তুত করা হয়েছে তাকে স্থান বলে।

কণ্ঠ সংগীতে সপ্তক ৩ প্রকার ও মন্ত্র স্থান, মধ্যস্থান, তার স্থান বা উদারা, মুদারা, তারা মন্ত্র বা উদারা সপ্তকের চিহ্ন স্বরের নিচে বিন্দু বা হসন্ত (স র গ ম প ধ ন)। মধ্য বা মুদারা সপ্তকের চিহ্ন নেই (স র গ ম প ধ ন)। তার সপ্তকের চিহ্ন স্বরের ওপরে বিন্দু বা রেফ ( র্স র্র র্গর্ম প ধ র্ন) শুল্ক ৭টি ও বিকৃত ৫টি স্বর এ ১২টি স্বর একটি সপ্তকের অন্তর্গত।

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment