তাল হলো ভারতীয় সঙ্গীতে বা নৃত্যে একটি ছন্দের নিয়ামক এবং ছন্দের অংশাদির আপেক্ষিক লঘুত্ব বা গুরুত্বের নির্ধারক। আজকে আমরা তাল বিভাগ সম্পর্কে আলোচনা করবো।

তাল বিভাগ
তাল
তাল শব্দের অর্থ হলো কাল পরিমাণ বা সময়ের মাপ। সংগীতে তালের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তালকে সংগীতের প্রাণ বলা হয়। সংগীতের যে সময়, তারই বিভাগই হলো তাল। গান, বাজনা ও নাচের গতি বা লয়ে স্থিতি নিরূপণ করাকে তাল বলা হয়। মাত্রার সমষ্টি দিয়ে তাল রচনা করা হয়। তাল দুই প্রকার। যথা,
সমপদী তাল
যেসকল তালের মাত্রা বিভাগ সমান তাদের সমপদী তাল বলা হয়। যেমন- একতাল, ত্রিতাল, সুরফাঁক।
বিসমপদী তাল
যেসকল তালের মাত্রা বিভাগ সমান নয় তাদের বিসমপদী তাল বলা হয়। যেমন- তেওড়া, ধামার, ঝাঁপতাল, ঝুমরা ইত্যাদি ।
সম
তাল শুরু হওয়ার মাত্রাকে সম বলে। অর্থাৎ প্রথম বিভাগের প্রথম মাত্রাই হলো সম । বাংলাদেশে ‘সম’-এর চিহ্ন হলো +।
তালি
বিভাগের প্রথম মাত্রায় হাতে তালি দিয়ে তাল ভাগ প্রদর্শন করাকে তালি বলে। যখন তবলা বাজানো হয় তখন বিভাগের শুরুতে (বিশেষভাবে সম (+) এর ওপর) জোরে আঘাত করা হয়। সম হলো যেকোনো তালের প্রথম তালি।
খালি :
বিশেষ বিভাগের শুরুতে কোনো মাত্রার ওপর তালি দেওয়া হয় না। সেসব স্থলে হাত কেবল পাশে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং সেগুলোকে খালি বলা হয়। অন্য কথায় তালির অনুপস্থিতিকেই খালি বলা হয়। এর অন্য নাম ফাঁক বা অনাগত। খালি চিহ্ন হলো ০।
মাত্রা
সংগীতের সময়কে (কাল) ক্ষুদ্র পরিচ্ছেদে মাপার জন্য যে মান স্থির করা আছে, তাকে মাত্রা বলে। এটি পাঁচ প্রকার অনুপ্রত, দ্রুত, লঘু, গুরু, পুত।
লয়
গতির সমতাকে রক্ষা করার নাম লয়। গতি তিন প্রকার- বিলম্বিত, মধ্য ও দ্রুত।
আবর্তন
তালের এক ফের অর্থাৎ তালের সম্পূর্ণ সময় প্রদক্ষিণ করে আসাকে এক আবর্তন বলা হয়।
পদ
তালের বিভাগকে পদ বা পদক্ষেপ বলা হয়। বা একে ‘অঙ্গ’ বলা হয়।
জাতি
তাল বিভাগের মাত্রাসংখ্যা বিচার করে জাতি নির্ধারণ করা হয়। পূর্বে তালসমূহ পাঁচ প্রকার জাতিতে বিভক্ত করা ছিল । যথা
চতুস্র জাতি- চার মাত্রা ও দুই মাত্রা বিভাগে মিশ্রিত।
ভিন্ন জাতি- তিন মাত্রা ও দুই মাত্রা বিভাগে মিশ্রিত।
মিশ্র জাতি সাত মাত্রা ও দুই মাত্রা বিভাগে মিশ্রিত।
খন্ড জাতি পাঁচ মাত্রা ও দুই মাত্রা বিভাগে মিশ্রিত।
সংকীর্ণ জাতি- নয় মাত্রা ও দুই মাত্রা বিভাগে মিশ্রিত।
বাংলাদেশে ব্যবহৃত ভালসমূহকে সাধারণত তিন জাতিতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা: চার মাত্রা, অথবা চার মাত্রা ও দুই মাত্রা বিভক্ত তালকে চতস্ৰজাতি বলা হয়। যেমন- চৌতাল, ত্রিতাল, কাহারবা ইত্যাদি। তিন মাত্রায় বিভক্ত তালকে ভিন্ন জাতি বলা হয়। যেমন- একতাল, দাদরা ইত্যাদি । দুই-তিন কিংবা তিন-চার অথবা দুই, তিন ও চারমাত্রায় বিভক্ত তালকে মিশ্রজাতি বলা হয়। যেমন- ঝাঁপতাল, ঝুমরা, ধামার ইত্যাদি।

ছন্দ ও ছন্দ বৈচিত্র্য
সংগীতে যাহাকে আমরা ভাল বলে ব্যবহার করি তা ছন্দ দ্বারাই গঠিত। অবশ্য আরও বহু কিছুর মধ্যে আমরা ছন্দের প্রকাশ দেখতে পাই। যেমন জলপ্রবাহ প্রাণী- বিশেষ চলনভঙ্গি ইত্যাদি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ছন্দের মাধুর্য আমরা উপলব্ধি করি সংগীতে। তবে সংগীতের যেসব ছন্দের বিকাশ হয় তৎসম্বন্ধে কিছু ব্যক্ত করা প্রয়োজন। ছন্দ প্রধানত দুই প্রকার। যথা: সমছন্দ ও বিসমছন্দ
সমছন্দ :
যার মিল আছে, অর্থাৎ একগুণ, দ্বিগুণ, চতুর্থগুণ ইত্যাদি ছন্দকে সমছন্দ বলা হয়।
বিসমছন্দ
যার মিল নেই অর্থাৎ অযুগ্ম। যেমন- সোয়াগুণ, দেড়গুণ, পৌণে দ্বিগুণ, আড়াইগুণ, তিনগুণ ইত্যাদি ছন্দকে বিসমা বা আড়ি ছন্দ বলা হয়। এই আড়ি ছন্দ প্রকারভেদে পাঁচ শ্রেণিতে বিভক্ত। যথা: আড়ি, কু আড়ি, বি আড়ি, দম্ ও খম।
ঠেকা
ঠেকা শব্দের অর্থ হলো ‘ঠেক’। কোনো বস্তু অবলম্বনে যে ক্রিয়া করা হয় সেই বস্তুকে ঠেক বলে। সেই প্রকার সংগীতে যেসব নির্দিষ্ট ছন্দ আছে, তা তবলা বা ওই জাতীয় বাদ্যের বোলের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়, এবং এই ছন্দোবদ্ধ বোলের অবলম্বনে সংগীত ক্রিয়া সাধিত হয় বলে এটি ঠেক নামে পরিচিত। সংগীত জগতে একে তালও বলা হয়ে থাকে। যেমন- ঠেকা ত্রিতাল, ঠেকা একতাল, ঝাঁপতাল ইত্যাদি।
মহড়া মওড়া বা মহরা
এর অর্থ ‘মুখ’ অর্থাৎ সম্মুখভাগ, ঠেকা অথবা অধিক পরিধির বোল পড়ন বাজাবার পূর্বে এই বোল ব্যবহৃত হয় বলে এটি মহড়া নামে অভিহিত। এ বোল চার হতে আট মাত্রায় মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং সাধারণত ফাঁক হতেই এর উত্থান হয়ে থাকে।
মহড়া-ঠেকা
তিৎ তা ঘেঘে তেটে । কেটেতাক তেরেকেটে তিক তাক তেরেকেট।
“ধা ধিন ধিন ধা
কৎ তা ধাধা থুনা । নাতি না-কেড়েনাকতাক তেড়েকেটে
ঘড়া ন ধা- তেরে কেটে তাক
এই প্রকার বোলকে মহড়া বলা হয় এবং এর ব্যবহারও এভাবে হয়ে থাকে । অবশ্য গতিভেদে এর পার্থ হতে পারে।
মুখড়া
মুখড়া মহড়ারই প্রকার ভেদমাত্র কারণ এদের নামের অর্থ বা ব্যবহার সবই এক। সেজন্য অনেক বানক মুখড়ী ও মহড়া একই বস্তু বলে স্বীকার করেন। কোনো কোনো বাদকগণের মতে এর রূপ ভিন্ন যারা ভিন্নভাবে এই বোলকে উল্লেখ করেছেন তাঁদের মতে এই বোলের রূপ হলো- সম স্থানে হতে এর উত্থান হয়ে তেহাইযুক্তভাবে সমস্থানে শেষ হবে। অর্থাৎ উক্ত মহড়ার বোল যদি তেহাইযুক্ত হয়ে সম হতে উত্থান হয় এবং সমে শেষ হয়, তখন সেই বোলকে মুখড়া বলা যেতে পারে। যেমন-
+
তিৎতা ঘেঘে তেটে। কেটেতাক তেকেটে তিকতাক তেরেকেটে
৩
ধা তেরেকেটে তিকতাক তেরেকেটে। ধা তেরেকেটে তিকতাক
+
তেরেকেটে। ধা

টুকড়া
টুকড়া বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি কোনো অধিকতর পরিধির বস্তুকে কিছু অংশে বিভক্ত করিয়া তাহার কোনো একটি অংশকে টুকড়া আখ্যা দেওয়া অর্থাৎ তবলার বোলসমূহের মধ্যে যেসব বোল অধিকতর পরিধি বিশিষ্ট, তারই কিছু অংশ বাজাবার সময় ব্যবহার করলে তাকে ন্যায়ত টুকড়া বলা উচিত।
টুকড়ার নমুনা
ধা – তেরে কেটেতাক। তা তেরে কেটেতাক
(১) ধাগেতেটে তাগেতেটে ক্রেষা ক্রে ধা কৎ
দিনদিন নানানানা কতেটো কৎ- তা।
ধা কতা ধাকতে টেধা- ক তাধা
কতাধা কতেটো কতা ধা কতা। ধা
(২) ধেৎ- তেটে তেটে ক্ৰেধিনানা। ধা কেটেতাক তা কেটেতাকদি
(৩) কেটেতাক ধাতি ধা জ্ঞান। ধা, কেটেতাক তা কেটেতাকদি – কেটে তাক, ধাতি ।
পেশকার
পেশকারের অর্থ হলো পেশ করা, অর্থাৎ পরিচয় দেওয়া তবলার একক বাদ্যের প্রারম্ভেই এই বোল বাজাবার রীতি হওয়ায় এর নাম হয়েছে পেশকার। অর্থাৎ তবলার পরিচয় দেওয়া। কোনো কোনো ওস্তাদএই বোলকে উত্থান বলেও ব্যবহার করেন। পেশকার বোলের গঠনভঙ্গি ও রচনা অতীব সুন্দর।
তবলা বাদক যদি এর স্বরূপ গঠনানুযায়ী বাজাতে পারেন। তা হলে শ্রবণে অতীব প্রীতিদায়ক হয়। এই বোল বেশি দ্রুত বাজাবার রীতি নেই। সাধারণত মধ্য লয়ে দ্বিগুণ বিলম্বিত লয়ে চতুর্থগুণ করে। বাজাতে হয় । এই বোল দিল্লি ও আগ্রা ঘরানাতে বিশেষ প্রচলিত দেখা যায়। নিম্নে পেশকারের উদাহরণ দেওয়া হলো
ধি-ক্রে ধিনতা-তা ধিনতা। ধাতেঃ ধাতেঃ ধাধা ধিনতা।
তেঃ- ধা গাধা -ধিন ধাতি। ধাকে ধাতি ধাধা তিনতা
কায়দা
এই বোল শুধু তবলা বাদ্যের জন্য রচিত হয়েছে। যে বোল অধিকতর বিস্তার করা যায়, শুধু সেই সব বোলেই কায়দার উপযোগী হতে পারে। তবলার একক বাসনকালে উত্থান বা পেশকার বাজাবার পরই সাধারণত এই বোলের ব্যবহার হয়। উদাহরণস্বরূপ দুইটি কায়দার প্রথম ভাগ নিম্নে দেওয়া হলো।
১। ধা তেটে ঘেড়েনাগ ঘেড়েনাগ তে। ধাধা ঘেড়েনাগ গুনা কেড়েনাগ। তা তেটে কেড়ে নাক কেড়েনাক তেৎ ধাধা ঘেড়েনাগ খুনা কেড়ে নাগ
২। ধা তে টেঘেড়ে নাকদে নেতাক। ধাধা নেতাকে। ধাধা -ঘেড়ে নাগদে নেতাক – – যেড়ে নাগদে নেতাক তা-তে টেকেড়ে নাগে

রেলা
যে বোল বেশ ঠাস ধরনে রচিত এবং বোলের অক্ষরসমূহ সমভাবে গঠিত তাকেই প্রাচীন ওস্তাদগণ রেলা বোল বলে উল্লেখ করেছেন। রেলা বোলের বিশেষত্ব এই যে এর বাণীসমূহের মধ্যে কোনো স্থানে বিরাম থাকবে না । এই বোল পরিবেশনে হাত খুব তৈরি থাকা প্রয়াজেন। কারণ এটি সাধারণত দ্রুত লয়ে চতুর্থগুণ, মধ্য লয়ে আটগুণ ও বিলম্বিত লয়ে ষোলোগুণে বাদিত না হলে এর প্রকৃত রূপ পরিদৃষ্ট হয় না। নিম্নে একটি প্রাচীন রেলা বোলের উদাহরণ দেওয়া হলো –
ধেরেধেরে কেটেতাক তাকতেরে কেটেতাক
তাকতেরে কেটেতাক ধেরেধেরে কেটেতাক
তেরেতেরে কেটেতাক তাকতেরে কেটেতাক।
তাকতেরে কেটেতাক ধেরেধেরে কেটেতাক।
তেহাই
এটাও একটি ত্রি-আবৃত্তির বোল। তবে এর পরিধি সাধারণত এক আবর্তনের মধ্যেই হয়ে থাকে। তেহাই শব্দের অর্থ হলো ত্রি ঘাত; অর্থাৎ নিয়মিত তিনটি, আঘাতযুক্ত কোনো ক্রিয়াকে তেহাই বলা যেতে পারে, তবে সংগীতের ক্ষেত্রেই এটি বিশেষভাবে পরিচিত।
বর্তমানে সর্বশ্রেণির সংগীতের মধ্যেই এটি ব্যবহৃত হয়, এবং সংগীত পরিবেশনে এর প্রয়োগ বিশেষ আকর্ষণীয়। সংগীতের ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সাধারণত দুই স্থানে হয়ে থাকে, যথা: সংগীতের স্থায়ী অর্থাৎ প্রথম পদ পুনরাবৃত্তির শেষাংশে, এবং সংগীতের পূর্ণ নিবৃত্তিতে। কারণ তেহাই ক্রিয়ার উদ্দেশ্যই হলো। শেষ করা অর্থাৎ নিবৃত্ত হওয়া।
তেহাই রচনার নিয়ম :
এই বোল বিভিন্ন ছন্দানুযায়ী রচনা করা যায়, তবে সমছন্দ অর্থাৎ একমাত্রার মধ্যে এক অক্ষর বা দুই অক্ষর সংযোগে সব মাত্রা বিন্যাসে রচনা করা সম্ভব নয়। সম-স্থানে যোগে ৯ ১২, ১৫, ১৮, ২১ ইত্যাদি মাত্রার মধ্যে এক অক্ষর এবং ৮, ১১, ১৪, ১৭ ইত্যাদি মাত্রার মধ্যে দুই অক্ষর কিন্তু উক্ত মাত্রা বিন্যাসের মধ্যে ৩, ৪, ৫ বা ততোধিক অক্ষর সংযোজিত তেহাই রচনা করতে হলে তিনটি আঘাত স্থানে এক অক্ষর, দুই অক্ষর বা তিন অক্ষরের ব্যবহার করতে হবে ।
নিম্নে ১, ২, ৩ ও ৪ অক্ষরের ৪ তেহাই এর উদাহরণ দেওয়া হলো।
এক অক্ষর – তে টে ধা তে টে ধা তে টে ধা।
দুই অক্ষর – ধাগে তেটে ধাধা গেতে টেখা ধাগে তেটে ধা
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭ ৮
তিন অক্ষর – ধাঘেনে ধাতেটে ধা ধাঘেনে ধাতেটে
১ ২ ৩ ৪ ৫
ধা ধাঘেনে ধাতেটে ধা
চারি অক্ষর – ধাগেতেটে গদিঘেনে ধা-গে তেটে গদি
১ ২ ৩ ৪
ঘেনেধা ধাগেতেটে গদিঘেনে
৬ ৭ ৮
উক্ত এক বা দুই অক্ষরযুক্ত তেহাই-এর মধ্যে আঘাত স্থানে বিরামের আবশ্যকতা রয়েছে। এই সব আঘাত স্থানে বিরামের আবশ্যকতা রয়েছে। এই সব আঘাত স্থানের বিরাম বিভিন্নভাবে প্রয়োগ করলে: একই তেহাই-এর বোল বিভিন্ন মাত্রা বিন্যাসের মধ্যে প্রয়োগ করা যায়। যেমন- সমস্থান যোগে আটমাত্রার একটি তেহাই।
তেটেকতা গদিঘেনে ধা-তেটে কতাগদি ঘেনেধা তেটেকতা
১ ২ ৩ ৪ ৫ ৬ ৭
গদিঘেনে ধা
৮

লগগী
এই বোল কাহারবা, দাদরা প্রভৃতি লঘু অঙ্গের তালে অধিক ব্যবহৃত হয়। ত্রিতাল প্রভৃতি তালে যেমন- “কায়দা” বোলের আছে, তেমনি কাহারবা, দাদরা প্রভৃতি তালে লগগী বোল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। ঠুংরি, গজল, ভজন প্রভৃতি গানের সঙ্গেই এর প্রয়োগ বেশি হয়। এই প্রকার বোলকে বাংলাদেশে অনেকে ‘ছবকী’ বোল বলে উল্লেখ করেন। উদাহরণ-
(১) ধাতি নাক নাতি নাক / নাতি নাক ধাতি নাক
ধাগ ধাতি নাতি নাক / নাক নাতি ধাতি নাক/
(২) বিগ্ নাথি তিধি নাড়া / ভি নাধি তিধি নাড়া
বাঁট
প্রাচীন ওস্তাদগণ ঠেকাসমূহের বিভিন্ন পাল্টা বা বিস্তারকে ‘বাঁট’ বলতেন। যেমন- তেতালার ঠেকা বিধিনাধি ধিনাধিনা ধিনাধিনা নাধিধিনা।
তিতি নানা ধিনাধিনা মাধিধিনা।
বর্তমান বালকগণের মতে এটি ‘লড়ী’ বোলেরই অংশ বিশেষ, অর্থাৎ ‘লড়ী’ বোল পুনরাবৃত্তি স্বরূপ বাদিত হলে তাকেই বাঁট বলা হয়। যেমন-
ধাতুননা ধা-তেরেকেটেতাক ধাতুননা তা- তেরেকেটেতাক ধাগেতেটে ক্রেধেতেটে ক্রেধেতেটে ক্রেধা নে ।
দ্বিপদী, ত্রিপদী ও চতুস্পদী
তবলার বোলসমূহের বাণীগুলো যদি দুইবার আবৃত্তি করে বাপিত হয় তা হলে তাকে তিনবার হইলে ত্রিপদী, চারবার হলে চতুস্পদী বোল বলা হয়। দ্বীপনী বোলের উদাহরণ-
ধাগেতেটে ধাগেতেটে ক্রেধেতেটে ক্রেধেতেটে ক্রেধা – নে ক্রেধা – নে ধাগেনধা গেনেকতে টেকতেটে – তেরেকেটেতাক, তেরেকেটেতাক তাঘ্রাণ তাকঘ্রাণ -ক্রাণ,
কেটেতাক তেরেকেটে ক্রাণ কেটেতাকতেরেকেটে ধা – কতা ধা-কতা ধা ।
মার্গ
মার্গ অর্থে পথ, অর্থাৎ যে রীতি বা ঢং-এ তালকে প্রদর্শন করা হয় তাকে মার্গ বলে। এর দ্বারা তালের কয়েকটি পন, মাত্রা, গতিভঙ্গি ও তাল ফাঁক কোন কোন স্থানে আছে তা বুঝা যায়।

ক্রিয়া
হস্তদ্বারা তাল ও ফাঁক প্রদর্শনকে প্রাচীনকালে ক্রিয়া বলা হতো। তাল দেওয়াকে সশব্দ ক্রিয়া ও ফাঁক দেওয়াকে নিঃশব্দ ক্রিয়া বলা হতো। এই তাল ও ফাঁক প্রদর্শনের একটি বিশেষ রীতি ছিল। যেমন- সশব্দ ক্রিয়া চার প্রকার যথা ভ্রুন্য, শম্পা, তাল ও সন্নিপাত।
ভ্রষ – অঙ্গুষ্ঠ ও রন্যমাঙ্গুলী দ্বারা তুড়ি দিতে দিতে হস্ত নিয়ে আনয়ন করা।
শম্পা – দক্ষিণ হস্তে তালি দেওয়া
তাল – বাম হস্তে তালি দেওয়া।
সন্নিপাত – উভয় হস্তে করতালি দেওয়া।
নিঃশব্দ ক্রিয়া বলতে চার প্রকার।
যথা : অবাপ, নিষ্কাম, বিক্ষেপ ও প্রবেশক।
অবাপ- হস্তকে উত্তোলন করে অঙ্গুলী কুঞ্চন করা ।
নিষ্কাম – অধঃস্থলের অঙ্গুলিসমূহ প্রসারিত করা।
প্রবেশক পুনরায় অঙ্গুলীসমূহকে সংকোচ বা কুঞ্চনায়িত করা।
বর্তমানে যেমন ভালো ফাঁক ইত্যাদির চিহ্ন দেওয়া হয়, শাস্ত্রগ্রন্থে মার্গ তালেও সেই প্রকার উরু ক্রিয়াগুলোর আদ্যাক্ষর, অর্থাৎ শম্পার ‘শ’ তালের ‘তা’ আবাপের ‘আ’ নিষ্কামের ‘নি’ ইত্যাদি তাল চিহ্ন হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে।
যেমন- মার্গতাল, ভচ্চংপুটঃ ২/২/১/৩ এর প্রথমে ‘সন্নিপাত’ দ্বিতীয় শম্পা তৃতীয় তাল চতুর্থ আবার শম্পা।
সংগীত রত্নাকর গ্রন্থে ধ্রুব সংযোগে আরও আটটি ক্রিয়ার উল্লেখ দেখা যায়। অর্থাৎ, ধ্রুব, সঙ্গিনী, কৃষ্ণা, পদ্মিনী, বিসজ্জিতা, বিক্ষিপ্তা, পতাকা ও পতিতা।

অঙ্গ
তালের পদ বা বিভাগের অঙ্গ বলে। এই অঙ্গ বিভিন্ন মাত্রা দ্বারা গঠিত হয়। যেমন- লঘু মাত্রার বিভাগ লঘু অঙ্গ, শুরু মাত্রার বিভাগ শুরু অঙ্গ ইত্যাদি ।
এই জন্য কোনো কোনো শাস্ত্রগ্রন্থে বিভিন্ন মাত্রাগুলোকেই অঙ্গ বলা হয়। যথাক্ষরা মার্গ তালে লঘু, গুরু ও দ্রুত অর্থাৎ একমাত্রিক, সামগ্রিক ও ত্রিমাত্রিক পদই সীমাবদ্ধ ছিল।
দেশি বা শাস্ত্রীয় তালে উক্ত তিন অঙ্গ ব্যতীত দ্রুত মাত্রার অঙ্গও প্রচলিত হয়। মতান্তরে লিখিত দেশি তালের মধ্যে অনুদ্রুত মাত্রার অঙ্গও দেখা যায়। বর্তমান তালপদ্ধতিতে সাধারণত দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক ও চতুর্থমাত্রিক অঙ্গের বিভাগ প্রচলিত আছে। তালের পদ দুই ভাবে গঠিত থাকে। যথা সমপদ ও বিষমপন।
যেমন ২/২/২/২,৩/৩/৩/৩/৪/৪/৪/৪/ এটি সমপদ এবং যেসকল তালের বিভাগ ২/৩/8, ৩/২/২/, ৪/২/৪ ইত্যাদি অসমান পদে বিভক্ত থাকে তা বিষমপদ। যেমন- বর্তমান, তেওড়া, সুরফাঁক, ধামার ইত্যাদি।
লয়কারী
লয়ের বিভিন্ন প্রকার ছন্দ বৈচিত্র্যকে লয়কারী বলে। যেমন- ঠায়, দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, আড় কুয়ারী, বিয়ারী প্রভৃতি
সমপদী তাল
দাদরা/কাহারবা/ত্রিতাল
দাদরাতাল
৬ মাত্রা বিশিষ্ট একটি তাল দুইটি বিভাগ প্রতিটি বিভাগে ৩টি করে মাত্রা।
১টি তালি ১টি খালি । ৩/৩ ছন্দ।
বোল
+ ধা ধি না / না তিন না
কাহারবা তাল
৮ মাত্রা বিশিষ্ট তাল। ২টি বিভাগ প্রতিটি বিভাগে ৪টি করে মাত্রা
৪/৪ ছন্দ। ১টি তালি ১টি খালি।
বোল
+ ধা গে তে টে/ না গেধি না।
ত্রিতাল
১৬ মাত্রা বিশিষ্ট তাল। ৪টি বিভাগ, প্রতিটি বিভাগে ৪টি করে মাত্রা ৪/৪/৪/৪ ছন্দ/ ৩টি তালি ১টি খালি ।
বোল
“ধা ধিন ধিন ধা ধা ধিন ধিন ধা না” তিন ” তিন “না।” তেটে “ধিন ধিন ধা 20
আরও দেখুনঃ