পর্ব ৩ : বাঁশি ধরতে শেখা!
আজকের পর্বে, আমরা শিখবো কিভাবে বাঁশি ধরতে হয়। যন্ত্রসঙ্গীতে, যন্ত্র ধরার উপায় নিয়ে প্রতিটি ঘরানায় দেখা যায় কিছু কঠর নিয়ম। যেকোন বাদ্যযন্ত্রের প্রথম পাঠ হয় যন্ত্র ধরতে শেখা। বিশ্বের যেকোন বাদ্যযন্ত্র ধরা এবং সেটা নিয়ে বসবার একটি বিশেষ কায়দা থাকে। যেহেতু সব মানুষের শারীরিক গঠন এক রকম নয়, তাই যন্ত্র ধরবার নিয়ম ব্যক্তিভেদে খানিকটা হলেও বদলে যায়। বাঁশিও তার ব্যাতিক্রম নয়। নতুন শিক্ষার্থীদের শিক্ষার শুরুতেই বাঁশি ধরতে কিছুটা অসুবিধা হওয়া খুবি স্বাভাবিক। নিয়মিত অনুশিলণে এই অসুবিধাগুলো চলে যায় খুব তাড়াতাড়ি।
[ পর্ব ৩ : বাঁশি ধরতে শেখা ]
বাঁশি ধবার বেশ কিছু উপায় আছে, এবং সেগুলো প্রত্যেকটিই নিজ নিজ জায়গাতে যৌক্তিক। ইউরোপিয়ান, ওয়েস্টার্ন, কিনবা উত্তর ভারতীয় এবং কারনাটিক সঙ্গীতের ধারাভেদে যেমন বাঁশি ধরার কায়দায় হয় বিভিন্ন নিয়ম, তেমনি বাদকের দৈহিক গঠন এবং আঙ্গুলের মাপের সুবিধা-অসুবিধা অনুশারেও বাঁশি ধরার উপায় পরিবর্তন করে নেয়া যায়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধারা অনুযায়ী বাঁশি ধরার কায়দা নিয়ে আমরা আজ কথা বলব। বাঁশি ধরার সুস্পষ্ট কোন কঠর নিয়ম না থাকলেও, সুরুতেই একটা গাইডলাইন থাকা খুবি জরুরি। এই ক্ষেত্রে আমরা বাঁশির ৩ মহারথি, পন্ডিত পান্নালাল ঘোষ, পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া এবং পন্ডিত রাজেন্দ্র প্রসন্নের দেখানো পধ্যতিগুলো নিয়ে আলচনা করবো। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, ভারতীয় উচ্চাং সঙ্গীতে একক বাঁশি বাদনে এই তিন গুণীজনদের গবেষণা এবং বাজনা সবচাইতে বেশি গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করা হয়।
শুরুতেই নির্ণয় করে নিতে হবে শিক্ষার্থীদের বাঁশি কোন দিকে থাকবে। বা-হাতি হলে বাঁশি ধরা হবে বাম কাধ বরারবর, এবং ডান-হাতি হলে ডান কাধ বরাবর। প্রথমেই, পন্ডিত পান্নালাল ঘোষের দেখানো পধ্যতি নিয়ে কথা বলব আমরা। পন্ডিত পান্নালাল ঘোষ, উচ্চাঙ্গ যন্ত্রসংগীতের মূল ধারায় বাঁশিকে একটি একক যন্ত্রের পূর্ণ মর্যাদা এনে দেন। পান্নালাল ঘোষ বড় ধরনের মন্দ্র সপ্তকের বাঁশির বাজনা নিয়েও অনেক প্রযুক্ত্রিগত উন্নয়ন করেন।
এই পদ্ধতিতে বাঁশি ধরতে, আমরা বাঁশির প্রধান ছয়টি ছিদ্র আটকাতে দুহাতের তর্জনী, মধ্যমা এবং অনামিকা ব্যাবহার করবো। এই পধ্যতিতে ধরে, অবশ্যই আঙ্গুলের ডগা/মাথা ব্যাবহার করবো। তাতে, আমাদের দুহাতের কনিষ্ঠার দখল বেড়ে যাবে বেশ অনেকখানি। কনিষ্ঠা ব্যাবহার করে কিছু বাঁশির অতিরিক্ত একটি ছিদ্র আটকে, মধ্যম স্বর ব্যাবহার করে কিছু সুবিধা নেয়া যায়, যা নিয়ে আমরা আগামিতে বিস্তারিত আলচনা করব।
এবার আমরা কথা বলব, পন্ডিত রাজেন্দ্র প্রশন্নের দেখানো পধ্যতি নিয়ে। তিনি উত্তর প্রদেশ, ভারতের বাসিন্দা ছিলেন। দুর্দান্ত বংশীবাদক হওয়ার পাশাপাশি, ছিলেন খ্যাতিমান সানাই বাদক। বাঁশি ধরার পধ্যতিটাও ছিলো বেশ অন্যরকম। আইরিশ ঊডেন ফ্লুট এবং ক্ল্যারিনেটের সাথে মিলে যায় অনেকটাই এই উপায়। বেশ অনেকটা যায়গা নিয়ে, শক্ত করে ধরতে হবে বাঁশি। আকারে, আঙ্গুলগুলো কিছুটা ছোট হলে এই পধ্যতিটিও ব্যাবহার করা যেতে পারে।
এবার আমরা কথা বলব পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার দেখানো পদ্ধ্যতি নিয়ে। আন্তর্জাতিক সঙ্গিতাঙ্গনে, এই নামের কোন পরিচিতি দরকার পরে না। বিশ্বব্যাপী ভারতীয় শাস্ত্রীয় যন্ত্রসংগীতে, বাঁশিকে বিস্বদরবারে অন্যতম স্থান করে দেন এই কিংবদন্তি। বিস্বের সিঙ্ঘভাগ ইন্ডিয়ান ক্ল্যাসিকাল বংশিবাদক তার দেখানো পধ্যতি অবলম্বন করেন। এই পধ্যতিতে বাঁশি ধরতে, শিক্ষার্থীদের আঙ্গুল্গুলো কিছুটা নামিয়ে নিয়ে আসতে হবে ডগা থেকে ( প্রথম উপায়টির সাথে তুলনামুলক)।
বাঁশির প্রথম তিনটি ছিদ্র আমরা বন্ধ করবো। এইখেত্রে, তর্জনী এবং মধ্যমার মাঝখান থেকে উচু একটি যায়গা ব্যাবহার করে প্রথম দুটি ছিদ্র বন্ধ করে (নিচ থেকে গুনলে, প্রতি আঙ্গুলের তিন নম্বর করের ঠিক নিচে) ত্রিতিয় ছিদ্রটি বন্ধ করতে হবে অনামিকার ডগা দিয়ে। একইরকম ভাবে, পরের তিনটি ছিদ্র ঠিক একই ভাবে অন্য হাতের আঙ্গুল্গুলো দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে। এইভাবে বাঁশির বাল্যান্স এবং গ্রিপ দুটোই কিছুটা মজবুত করা যায়। তাছাড়া, বাঁশির উপরের দিকের বুড়োআঙুলের কাছে পঞ্চমের “থাম্ব হোল” আটকানোটাও সহজ হয়ে যায় অনেক অংশেই।
এই পধ্যতি সিঙ্ঘভাগ বাঁশি শিল্পীরা অবলম্বন করে থাকলেও, এইভাবে অনেকেরি ধরতে কিছুটা অসুবিধা হতেই পারে, এবং তাতে একদমি ভয় পেয়ে যাবার কারন নেই। মনে রাখতে হবে, যেই পধ্যতিটি কিছুটা আরামদায়ক মনেহচ্ছে, সেই পধ্যতিটিই আপনার জন্য সঠিক।
এবার বাঁশি তে “সা” বাজিয়ে শব্দ বের করার সময় হয়েছে।
হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের নিয়মে, একজন শিল্পীকে সর্বপ্রথম একটি স্কেল নির্ধারণ করতে হয়। “এ” থেকে “জি শার্প” পর্যন্ত স্কেল এর মাপকাঠি। এই স্কেল্গুলোর “টনিক” কিনবা প্রথম স্বরকেই আমরা “সা” কিনবা সরজ বলে থাকি। যেকোন স্কেলের বাঁশিই কিনতে পাওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের নিজেদের বাঁশির স্কেল জানা থাকা অব্যশক। নতুন শিক্ষার্থীদের বাঁশি কেনার পরামর্ষে, সাধারনত “ই” স্কেলের বাঁশি কিনতে বলা হয়। এবার, উপরে বর্ণিত যেকোন উপায় বাঁশি ধরে, প্রথম ৩টি ফুটা বন্ধ করে দিতে হবে। এরপর বান্সুরি গুরুকুলের দ্বিতিয় পর্বে দেখানো উপায় অনুশরন করে ফুঁ দিলেই “সা” বাজতে শুরু হবে।
নতুন শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকেই কিছু অসুবিধার সম্মুখীন হওয়া খুবি স্বাভাবিক। এই ক্ষেত্রে একদমই ভয় না পেয়ে, স্থির হয়ে দেখানো কায়দাগুলো অনুশীলন করলেই সুফল পাওয়া যাবে। বাঁশি ধরতে শেখা এবং সুর বের করতে শেখা নিয়ে বান্সুরি গুরুকুলে আমাদের ভিডীও টিউটোরিয়াল দেখার আমন্ত্রন রইল।
আরও দেখুন: