বাঁশির কথা । উত্তম চক্রবর্তী

আজকের আলোচনার বিষয়ঃ বাঁশির কথা। ইতালির লুকুয়ানো বারনাদি বলেছেন, “সংগীত হৃদরোগের ঝুঁকি কমায় আর ই পয়কে তরতাজা রাখে।” সক্রেটিস বলেছেন, “সংগীত হলো আত্মার খাদ্য। যেখানে সংগীত আছে সেখানে বেঁচে থাকার আনন্দ আছে।

 

বাঁশির কথা । উত্তম চক্রবর্তী

 

বাঁশির কথা । উত্তম চক্রবর্তী

শেকসপিয়র বলেছেন, “সংগীত যদি ভালোবাসার উপকরণ হয় তাহলে তোমরা আমাকে আরও দাও। এই ভালোবাসা থেকেই সংগীতের প্রতি আমার দুর্বলতা সংগীত পরিবারেই আমার জন্ম। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ডা. ভুবনেশ্বর চক্রবর্তী উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনেক বড়ো মাপের ওস্তাদ ছিলেন। সন্ধ্যার পরই প্রতিদিন বাড়িতে জলসা বসত। রাতের পর রাত নামকরা বড়ো বড়ো ওস্তাদ পরিবেশন করতেন হৃদয় ভরা ভালোবাসার সুর। ফুলের বাগান থেকে ছড়িয়ে পড়ত সু-ঘ্রাণ। আমি মোহিত হয়ে যেতাম। তাই ছোটোবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি আমার ঝোঁক। বাউলের একতারার সুর ভোরের বৈরাগীর সুর-

“প্রভাত কালের শচীর আঙ্গিনার মাঝে

জাগো জাগো শচী মাতা,

গৌর চাঁদ নাচিয়া বেড়ায়,

গৌর এল প্রেমদাতা-

ঘরে ঘরে হরিনাম বিলায়রে।”

বৈরাগীদের এসব সুর আমার ভালো লাগত। আর রাখালের বাঁশি আমাকে পাগল করে তুলত। তাই বাঁশিকেই শক্ত করে ধরি। যাদের কাছে তালিম নিই তারা বিজ্ঞজন। শৈলেন বাড়ৈ, ছানোয়ার হোসেন, আব্দুল ওয়াহেদ, মরহুম ওস্তাদ আব্দুর রহমান, সুরকার দেবু ভট্টাচার্য ও পান্নালাল ঘরানার ব্যারিস্টার তৌফীক নাওয়াজ। যার কাছে আমি তালিম নিয়েছিলাম। যিনি পরম্পরায় এই উপমহাদেশের দুহাজার বছরের ঐতিহ্য মন্ডিত ধ্রুপদ সংগীতকে ধরে রেখেছেন। তিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ঘরানার মানুষ। তাঁর বাবা আমিনুর রহমান পান্নালাল ঘোষের শিষ্য ছিলেন। পান্নালাল ঘোষ যিনি ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর বাঁধনে আবদ্ধ ছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ, ওয়াজীর খাঁর শিষ্য আবার ওয়াজীর বা তানসেন ঘরানায় পরম্পরায় আবদ্ধ ছিলেন।

 

google news
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

এই উপমহাদেশের সংগীতের পদ্ধতি অতি প্রাচীন। মৌলিক ভাবসম্পন্ন এবং তার সংস্কৃতিও সনাতন। আমাদের দেশে সর্বত্রই এই সংগীতের প্রভাব বহু যুগ ধরেই বিস্তৃত। পূর্ব-পশ্চিম বাংলায় এই সংগীত প্রান্তের সমস্ত সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে। শুধু তাই নয় এই উপমহাদেশের প্রচলিত শাস্ত্রীয় শিক্ষাপদ্ধতিও। যা বাংলাদেশের সর্বত্র স্বীকৃত হয়েছে- একথা সবাই জানেন। কিন্তু বিবর্তন বা পরিবর্তন ছাড়া পৃথিবীতে কোনো অস্তিত্বই টিকে থাকতে পারে না এবং সেই নিয়মে প্রাচীনতম সংগীতেরও শাস্ত্র, রীতি, পদ্ধতি, নিয়ম-কানুন, রূপায়ণ পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। সংস্কার পুনর্গঠন ইত্যাদি আবশ্যিকতার জন্য। প্রাচীন ও ক্রমবিবর্তিত এই শিক্ষার ধারা ও ক্রিয়াসিদ্ধ সংগীতের দিকে লক্ষ রেখেই তালিম পর্যায়ের বাঁশির এই বইটি বের করার প্রয়োজন অনুভব করি। বাঁশি আমাদের ঐতিহ্য তাই বাঁশির প্রতি আগ্রহী মানুষের কথা ভেবেই কাজটি শুরু করি।

শাস্ত্রীয় সংগীতের পাশাপাশি বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন সাংগীতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিদেশি গান বাজনার অনেক চাপ বাংলাদেশের সংস্কৃতির সাথে মিশে যাওয়ার ফলে কিছু নতুন মাত্রা যোগ হলেও তেমনি সৌন্দর্যেরও বিকৃত বা হানি ঘটেছে। কিন্তু বিভিন্ন রংঢংয়ের গান-বাজনা হলেও শিক্ষার একটি বিশেষ দিক রয়েছে। একথা সবাই জানেন এবং থাকা উচিত।

এই সর্বজনীন প্রয়োজনীয়তার কথা ভেবেই আমার এ উদ্যোগ। যারা গান-বাজনাকে নিখুঁত করতে চান, শিখতে চান, সেই শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু অন্তত সাহায্য হবে বলে আমি মনে করি।

আমি যখন ২৬ বঙ্গবন্ধু এভ্যিনুতে নাট্যজন মামুনুর রশীদের অফিসে তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করতাম, তখন প্রয়াত নাট্যজন এস এম সোলায়মান ভাইয়ের সহযোগিতায় উচ্চাঙ্গ ঘরানার শিল্পী তপন বৈদ্যের মাধ্যমে ব্যারিস্টার তৌফীক নাওয়াজের কাছে আসি- তিনি আমাকে নতুন করে শুরু করলেন। কারণ তাদের ঘরের বৈশিষ্ট্যই নাকি আলাদা। তাদের ঘরের বাঁশি তাই অন্যরকম ভাবে ধরে শিখতে হয়। অর্থাৎ পান্নালাল ঘোষ যেভাবে বাঁশি ধরতেন এবং বাজাতেন। আমিও নতুন করে শুরু করি। ভালোবেসে ঘরানার নীতি ও আদর্শকে শক্তভাবে ধরি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা মূল্য দিতেন মানুষের চিত্তবৃত্তিকে। তারা বিকশিত চিত্তের মানুষ ছিলেন এবং সাধনা করেছেন। তাদের সম্মান ধরে রাখার জন্য ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিকে তুলে ধরার জন্য দেশকে ও বাঁশিকে মহিমান্বিত করার জন্যই আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।

 

বাঁশির কথা । উত্তম চক্রবর্তী

 

বাংলাদেশে বাঁশির ওপর কোনো বই নেই। বাঁশি শিক্ষার জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। শিখতে চাইলেও কোনো ওস্তাদ পাওয়া যাবে না। যারা রয়েছেন তারা ভীষণ ব্যস্ত কমার্শিয়াল কাজে। বাঁশি আমাদের দেশের একটা ঐতিহ্য। তাই এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য এবং বাঁশিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বাঁশরি সংগীত একাডেমীর মাধ্যমে বাঁশি শেখানো শুরু করি। বর্তমানে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে আমার উদ্যোগে বাঁশির কোর্স শুরু হয়। সেখানে আবার বাঁশি শেখানো শুরু করেছি। সেইসাথে একটি বাঁশির বই বের করার পরিকল্পনা করি। আমাদের নতুন প্রজন্ম যাতে এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে পারে সেই দায়বদ্ধতা থেকে কাজটি করছি।

সংগীতের জগৎ নির্মল আনন্দের উৎস। সংগীত মানুষকে জাগ্রত করে তার প্রাণে উপলব্ধি ও জীবনবোধের আনন্দ সঞ্চার করে। দ্বাপর যুগে ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজাতেন। যিনি মুরলীধর কৃষ্ণ নামেও পরিচিত । তিনি বাঁশি বাজিয়ে লীলা করতেন। তাই বাঁশির সৃষ্টিকর্তা হিসেবে তাঁকেই মানা হয়। বাঁশির সুর নিরাকার শক্তি। বাঁশিতে চায় বি+জ্ঞান = বিজ্ঞান (বিশেষ জ্ঞান) সত্যপথে যে জ্ঞানের ভিতর চৈতন আছে। আর সুর হচ্ছে সুধা (সৃষ্টিকর্তা যার মধ্যে থাকে)।

মহাসম্ভূতি (যিনি জগৎ সৃষ্টি করেছেন) তার হাতে বাঁশি। তাই বাঁশির প্রথম ছিদ্রকে (অর্থাৎ ফুঁ দেওয়া হয় যে ছিদ্রে শ্রী (শক্তিমান) বলা হয়। পিছনের ছিদ্রকে বলা হয় কৈব্যাল্য (শিব)। বাঁশির ছয় ছিদ্রের নাম হলো- কামকোষ, জ্ঞানকোষ, বিজ্ঞান কোষ, অভিমানথ কোষ, চিত্ত ও কটূন্ত চৈতন্য। তাই বোধের মাধ্যমে নিরাকার শক্তিকে বুঝতে হয়। আর কুলকুন্ডলিনীকে ঠিক রাখলেই অহং (জীবাত্মা) জ্ঞান, মন সব ভালো থাকে। তাই চিত্তরঞ্জনের জন্য সংগীত।

দ্বীজ চণ্ডীদাসের কীর্তনে শুনি-

সখীরে আমি শ্যামের বাঁশি শুনেছি

এখনও তার রূপ দেখিনি ।

বাঁশি শুনেই প্রেম করেছি।

না জানি তার রূপ কেমন।

আবার পাগল বিজয় বলে-

আমি নীরবে দাঁড়িয়ে কাঁদিরে

আমার দিন যায় কদম তলায়।

ওরে আমার শ্যামল বংশীওয়ালা।

বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন-

বিস্মৃত সেই বংশীধ্বনি

কর্ণরক্তে প্রবেশ করিল

এত মধুর লাগিল কেন?

সাধন মন যখন ব্যাকুল হয়ে উঠে তখন চৈতন্যকে পাবার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠে। বাঁশের বাঁশি আমাদের শিল্প, সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে মিশে আছে। বাঁশিকে কেন্দ্র করে গুণীজনেরা অংসখ্য গল্প, কবিতা, গান লিখেছেন। বাঁশির সুরে প্রেম, বিরহ, দুঃখ-আনন্দের যে অনুভূতি তা আমাদের হৃদয়কে দোলা দেয়। তাইএকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার। ঐতিহ্যবাহী সুরের এই যন্ত্রটির জনপ্রিয়তা এবং উৎসাহী শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করার জন্যই আমার এ সামান্য প্রচেষ্টা।

 

বাঁশির কথা । উত্তম চক্রবর্তী

 

বাদ্যযন্ত্ৰ সংগীতোপযোগী শব্দ সৃষ্টিকারী যন্ত্র যা কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীতে ব্যবহৃত হয়। বাঁশি তার মধ্যে অন্যতম। এই উপমহাদেশে প্রাচীন সাহিত্য থেকে অতি উন্নত মানের এক সাংগীতিক সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় এবং সেই সূত্রে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের পরিচয় মেলে। সিন্ধু সভ্যতায় বেণু, বীণা ও মূলঙ্গের ব্যবহার ছিল। বৈদিক যুগে দুন্দুভি, ভূমি-দুন্দুভি, বেণু ও বীণা প্রভৃতি গঠন ও উপাদানগত দিক থেকে বাদ্যযন্ত্ৰসমূহ তত, শুষির, ঘন ও আনদ্ধ এই চার শ্রেণিতে বিভক্ত।

ততযন্ত্র তার সংযুক্ত, ফুঁ দিয়ে বাজানো হয় যেগুলো সেগুলো শুষির, ধাতু নির্মিত যন্ত্র ঘন এবং চামড়ার আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি যন্ত্রের নাম আনছ। তত ও শুষির যন্ত্র সংগীত বা অন্য যন্ত্রের সঙ্গেও বাজানো যায়। আবার এককভাবেও বাজানো যায়। তাই এগুলোর অপর নাম স্বয়ংসিদ্ধ যন্ত্র, যেমন- সেতার, সরোদ, বাঁশি, সানাই প্রভৃতি।

খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতকে বিখ্যাত চৈনিক পর্যটক ফা-হিয়ান প্রাচীন বাদ্যযন্ত্র দেখে এ দেশকে সংগীত ও নৃত্যের দেশ বলে আখ্যায়িত করেন। খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতকে নির্মিত পাহাড়পুর ময়নামতি প্রস্তর ফলক ও পোড়ামাটির চিত্রে নৃত্য ও বাদ্যরত মনুষ্যমূর্তি পাওয়া গেছে। এতে কাঁসর, করতাল, ঢাক, বীণা, মৃদঙ্গ, বাঁশি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রের চিত্র দেখা যায়। ঢাক, ডফ, ডমরু প্রভৃতি আনদ্ধ এবং শিঙ্গা, বাঁশি, তুবড়ি ও শুষির যন্ত্রকে দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর অবদান বলে মনে করা হয়।

চৌদ্দ শতকের বৈষ্ণবকাব্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে মুরলি বা মোহনবাঁশি ছাড়াও করতাল ও মুনঙ্গের কথা আছে। ষোলো শতকে চৈতন্যদেবের প্রবর্তনায় কীর্তন জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। যার প্রধান বাদ্যযন্ত্র খোল, করতাল, মন্দিরা, বাঁশি। শুষির শ্রেণি বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে বাঁশি সবচেয়ে জনপ্রিয়। সব সম্প্রদায়ের বা সব শ্রেণির মানুষই বাঁশি বাজাতে কিংবা শুনতে পছন্দ করে। বাঁশির সুর গানের বাণীকেও ফুটিয়ে তোলে। লোকসংগীতের ক্ষেত্রে বাঁশি ও দোতরা বিশেষ ভূমিকা রাখে। সারি, জারি, ভাওয়াইয়া, যাত্রা, ঘেঁটু, কবি গানে বাঁশির ব্যবহার চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলে।

বাঁশির উপকরণ অতি সাধারণ। বাঁশের নল কেটে এক দেড় ফুট লম্বা চিকন বাঁশ দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। আবার কোনো কোনো বাঁশির দৈর্ঘ্য অনেক বেশি হয়ে থাকে। মাথার দিকে একটি গিট রেখে বাঁশ কাটা হয়। যাতে ওপরের দিকটা বন্ধ থাকে। আবার এর অপর প্রান্ত থাকে খোলা। গিটের কাছে একটি গোল ছিদ্র করা হয়। এটিকে বলে ফুৎকার রন্ধ্র। এর নিচে থাকে পরপর ছয়টি গোল ছিল: এগুলোকে বলে তাররস্ত্র । ফুৎকার রন্ধ্রে মুখ রেখে আড়াআড়িভাবে বাঁশিটি ধরে অপর ছিদ্রগুলোতে দুই হাতের তর্জনী, মধ্যমা ও অনামিকা দিয়ে বায়ু নিয়ন্ত্রণ করে এটি বাজানো হয়।

 

consmetic gula

 

আকার ও প্রকারভেদে বাঁশির বিভিন্ন নাম আছে। যেমন- আড়বাঁশি, কঁদবাশি, টিপারা বাঁশি, হরিনাম বাঁশি ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে আড়বাঁশি সর্বাধিক প্রচলিত। এর অপর নাম মুরলি, মোহনবাঁশি, বেণু প্রভৃতি । শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কৃষ্ণের মুরলি বা মোহনবাঁশিকে আড়বাঁশি বলা হয়েছে। কৃষ্ণ এই বাঁশির সুরেই রাধার চিত্ত হরন করেছিলেন। ময়মনসিংহের একটি লোকসংগীতে বলা হয়েছে, “আট আঙ্গল বাঁশের বাঁশি মধ্যে দিয়ে ছেঁদা, নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশি কলঙ্কিনী রাধা

কদবাশির মাথা তেরছাভাবে কেটে কাঠের পাতলা খিল আঁটা হয়। এবং সেখানে ঈষৎ ছিদ্রপথে ফুঁ দিলেই এটি বাজে। এর নিচে চারকোনাকার একটি উন্মুক্ত বায়ুরন্ধ থাকে। অঞ্চলভেদে কদবাশির বিভিন্ন নাম আছে। যেমন- মুখের মধ্যে পুরে বাজাতে হয় বলে উত্তরবঙ্গে “মুখবাশি”, মুখের কাছে খিল থাকে বলে ফরিদপুরে খিলবাশি এবং মুখ কলমের মতো দেখায় বলে কলমবাশি বলা হয়। আদিবাসিরা একে বলে লয়বাশি।

টিপারাবাশি উভয় মুখ খোলা এবং এতে আটটি ছিদ্র থাকে। কদবাশির মতো মাথায় ফুঁ দিয়ে এটি ৰাজানো হয়। তবে উভয় প্রান্ত খোলা থাকে বলে এর বাদনে বিশেষ কৌশল ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন। হরিণাবাশি প্রকৃতপক্ষে হরিণ শিকারের বাঁশি। প্রায় এক ফুট দীর্ঘ এ বাঁশির উভয় প্রাপ্ত এবং গায়ে কোন ছিদ্র থাকে না। এতে ফুঁ দিলে হরিণ শিশুর ডাকের মতো আওয়াজ হয়। এ থেকেই এর নাম হয়েছে হরিণাবাশি।

এছাড়া আরও বিভিন্ন ধরনের বাঁশি রয়েছে। পাতাবাশি, ভেঁপুর্বাশি, ভেরীবাঁশি। তালপাতা দিয়ে পাতা বাঁশি তৈরি করা হয়। ভেঁপু অঙ্কুর গজানো আম আঁটির খোসা ছাড়িয়ে জোড়াবিচি তেরছাভাবে সামান্য ঘষে তৈরি করা হয়। তেরছা অংশ মুখে পুরে ফুঁ দিলে পুঁ পুঁ ধ্বনি সৃষ্টি হয়। এ থেকেই এর নাম হয়েছে ভেঁপু। গ্রামের শিশুদের এটি প্রিয় বাদ্যযন্ত্র। ভেরী পিতলের তৈরি বাঁশি জাতীয় যন্ত্র। পূর্বে রণক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হতো।

বিশ্বের প্রায় সকল আদিবাসী জনগোষ্ঠীই নৃত্যগীত প্রিয়। বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীসমূহ তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে। তাদের নৃত্যগীতে ব্যবহৃত হয় তনদা, টামাক, ডানডা, ঢাক, ঢোল, বাঁশি, সিঙ্গা, মাদল প্রভৃতি যন্ত্র। উপজাতীয়দের বাঁশি জাতীয় যন্ত্রের মধ্যে রয়েছে পুং তু, বাজি, শিমুর, শিঙ্গা ও ক্লাওনেট। পুং ঐতিহ্যগতভাবে মৌ ভাষায় পুং শব্দের অর্থ বাঁশি। পাহাড়ে উৎপন্ন এক প্রকার তিতা লাউয়ের খোল এবং সরু বাঁশের নল দ্বারা মৌ এবং খুমি জনগোষ্ঠী নিজস্ব কারিগরি ও কলাকৌশলে পুং তৈরি করে থাকে।

সংগীত সাধনার বস্তু। একথা মনে রেখেই নিয়মিত নিষ্ঠার সাথে শিক্ষার বস্তুগুলো সাধনা করলে এর সুফল শিক্ষার্থীরা অবশ্যই পাবেন ।

শিক্ষার সাথে শিক্ষার বিষয় কোনোকিছুকেই যেন সাধারণ বা মামুলি ভেবে শিক্ষার্থীরা অবজ্ঞা না করেন। কারণ একথা অনস্বীকার্য যে, যা অনেক সময় মামুলি বলে মনে হয় সেই বস্তুই অনেক সময় শিল্পীর জাদুর স্পর্শে পরিবেশনের গুণে অসাধারণ হয়ে ওঠে। কে বলতে পারে আপনাদের মধ্যে ভাবীকালের কোনো শিল্পী লুকিয়ে আছে কি না!

 

 

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment