আজ বাঁশির যাদুকর পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষের জন্মদিন !!

‘মুঘল-এ-আজম’ (১৯৬০) ছবির মধুবালার ওপর চিত্রায়িত, লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া “মোহে পনঘাট পে নন্দলাল…” গানটি মনে আছে নিশ্চয়ই। এই গানে বাঁশির সুর তুলেছিলেন সংগীত পরিচালক নওশাদের আমন্ত্রণে আসা কিংবদন্তি বংশীবাদক পণ্ডিত পান্নালাল ঘোষ—ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর শিষ্য, যিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে বাঁশিকে একক ধ্রুপদী যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার কৃতিত্ব অর্জন করেন।

আজ, তাঁর ১১৪তম জন্মবার্ষিকীতে, শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি সেই বিস্মৃতপ্রায় মহান শিল্পীকে, যিনি বাঁশিকে নতুন মর্যাদা ও পরিচয় দিয়েছিলেন।

প্রারম্ভিক জীবন ও সংগীতের সূচনা:

১৯১১ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির বরিশালে, কীর্তনখোলা নদীর তীরে জন্ম নেন অমল জ্যোতি ঘোষ—পরে যিনি পান্নালাল ঘোষ নামে খ্যাত হন। তাঁর পিতামহ হরকুমার ঘোষ ছিলেন প্রখ্যাত ধ্রুপদী গায়ক, পিতা অক্ষয় কুমার ঘোষ একজন প্রসিদ্ধ সেতারবাদক, আর মা সুকুমারী ছিলেন দক্ষ কণ্ঠশিল্পী। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি বাঁশি শেখা শুরু করেন। তাঁর ছোট ভাই নিখিল ঘোষ পরবর্তীতে খ্যাতিমান তবলাবাদক হন।

বংশীবাদনের পাশাপাশি পান্নালাল শরীরচর্চাতেও পারদর্শী ছিলেন—১৯৩৬ সালে ব্যান্টম ভারোত্তলন প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। কৈশোরে তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন এবং পুলিশের চোখ এড়াতে ১৯২৬ সালে বরিশাল থেকে কলকাতায় চলে আসেন।

কলকাতা ও নিউ থিয়েটার্স:

কলকাতায় এসে তিনি নিউ থিয়েটার্স ফিল্ম কোম্পানিতে যোগ দেন। ১৯৩৫ সালে ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স’-এ প্রথম পুরস্কার পান। এখানে ওস্তাদ খুশি মহম্মদের কাছে মার্গসংগীত এবং গিরিজাশঙ্করের কাছে শিক্ষালাভ করেন। যদিও তাঁর প্রকৃত খ্যাতি আসে বংশীবাদক হিসেবে।

১৯৩৮ সালে সেরাইকেল্লার যুবরাজের নৃত্যদলের সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণ করেন এবং পরে দেশ-বিদেশের অসংখ্য কনফারেন্সে বাঁশি বাজিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও তিনি একাধিক ঐক্যতানবাদনের নেতৃত্ব দেন।

চলচ্চিত্রে অবদান:

১৯৪০ সালে তিনি মুম্বাইয়ে পা রাখেন সংগীত পরিচালক হিসেবে। তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ছিল স্নেহবন্ধন (১৯৪০)। পরবর্তী সময়ে আনজান (১৯৪১), বসন্ত (১৯৪২), দুহাই (১৯৪৩), নন্দকিশোর (১৯৫১), বসন্ত বাহার (১৯৫৬), এবং মুঘল-এ-আজম (১৯৬০)–সহ বহু ছবিতে তাঁর বাঁশির সুর বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। আঁধিয়া (১৯৫২) ছবির আবহসংগীতে তিনি ওস্তাদ আলী আকবর খান ও পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করেন।

১৯৪৭ সালে আলাউদ্দিন খাঁর কাছে কিছুদিন শিক্ষালাভ করেন এবং তাঁরই অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি করেন নতুন রাগ—নূপুরধ্বনি, চন্দ্রমৌলি, দীপাবলি, কুমারী প্রভৃতি। ফৈয়াজ খান ও ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের মতো খ্যাতনামা কণ্ঠশিল্পীদের অনুরোধে তিনি খেয়ালের সঙ্গতও করেছেন বাঁশিতে। ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় বন্দি অবস্থায় অসুস্থ মহাত্মা গান্ধীকে বাঁশি শুনিয়ে তাঁর আশীর্বাদ পান।

বাঁশির আধুনিক রূপের উদ্ভাবন:

পান্নালাল ঘোষই বাঁশিকে আধুনিক রূপ দেন। তিনি ৩২ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের সাত ছিদ্রবিশিষ্ট বাঁশি উদ্ভাবন করেন, যা বাজানো সহজ এবং সব স্বর নিখুঁতভাবে প্রকাশ করতে সক্ষম। সপ্তম ছিদ্র যুক্ত করে তিনি আগেকার বাঁশির সীমাবদ্ধতা দূর করেন এবং বাঁশিকে সেতার, সরোদ, শানাই, সারেঙ্গীর সমকক্ষ স্থানে উন্নীত করেন, যা ধ্রুপদী সংগীতে একক যন্ত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সম্মাননা ও ব্যক্তিগত জীবন:

তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কারপদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন। তাঁর স্ত্রী পারুল ঘোষ ছিলেন বিখ্যাত নেপথ্য গায়িকা।

শেষ জীবন ও উত্তরাধিকার:

১৯৫৬ সালে তিনি আকাশবাণী দিল্লি কেন্দ্রে সংগীত নির্দেশক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬০ সালের ২০ এপ্রিল তিনি প্রয়াত হন।

বাঁশির সুরে যিনি গড়ে তুলেছিলেন এক নতুন ভাষা, সেই পান্নালাল ঘোষ ছিলেন কেবল একজন শিল্পী নন—ছিলেন এক যুগান্তকারী উদ্ভাবক ও সংগীত-দ্রষ্টা। তাঁর পথ অনুসরণ করেই আজ শাস্ত্রীয় সংগীতে বাঁশি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

#everyoneシ゚ #followersシ゚ #highlightsシ゚ #foryoupageシ#foryouシ #পান্নালাল_ঘোষ  #legends #indianclassicalmusic #bansuri #bansurigurukul #gurukulonlinelearningnetwork #goln

Leave a Comment