আজকের আলোচনার বিষয়ঃ ঠাট বা মেল
ঠাট বা মেল
একটি সপ্তকে ১২টি স্বর থেকে ঠাট বা মেল উৎপন্ন হয়েছে। ঠাট একটি আদর্শ স্বরগ্রাম মান অর্থাৎ সপ্তকের অন্তর্গত স্বরসমূহের বিশিষ্ট রচনাকে বা ষড়জাদি শুদ্ধ ও বিকৃত স্বরের বিভিন্ন প্রকারের যোজনা যারা যে শ্রেণিভাগ করা হয় তাকে ঠাট বা মেল বলে। প্রত্যেক ঠাটে সব সময় ৭টি স্বর ক্রমানুসারে ব্যবহৃত হয়। ঠাঁট গতিহীন তাই আমরা ঠাটে আবৃত্তি বা গান কোনোটাই করি না। ঠাট হলো রাগের শ্রেণিবিভাগ করার একটি উপায় মাত্র। অতএব, গানের সৌন্দর্য বর্ধিত করার জন্য রাগের ন্যায় ঠাটের মধ্যে সব বৈশিষ্টগুলো পাওয়া যাবে না। তাই ঠাট থেকে রাগের এবং রাগ থেকে গীতের সৃষ্টি।
এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, ঠাটের জন্ম হলো কী করে? একথা জানতে হবে যে প্রতিটি সপ্তকের একটি পূর্বাঙ্গ (পূর্ব অংশ, ৪টি স্বর : সরগম) এবং একটি উত্তরাঙ্গ (তার অংশ, ৪টি স্বরপ ধ ন র্স) এভাবে প্রথম ঠাটের জন্ম – স র গ ম প ধ ন র্স। তারপর পূর্বাঙ্গ এবং উত্তরাঙ্গে সর্বদা নতুন বিকৃত স্বর যোগ করে ঠাটের সৃষ্টি হয়। এভাবে ৭২টি ঠাট পাওয়া যেতে পারে। প্রাচীন শাস্ত্র মতে ৭২টি ঠাট ছিল এবং দক্ষিণে কর্ণাটক সংগীত পদ্ধতিতে ৭২টি ঠাট রাখা হয়েছে। ভারতীয় সংগীত পদ্ধতিতে সাধারণত ১০টি ঠাট ব্যবহার হয়ে থাকে। যথা:
বিলাবল | সা | রা | গা | মা | পা | ধা | না | র্সা |
খাম্বাজ | সা | রা | গা | মা | পা | ধা | ণা | র্সা |
কল্যাণ | সা | রা | গা | ক্ষা | পা | ধা | না | র্সা |
কাফী | সা | রা | জ্ঞা | মা | পা | ধা | ণা | র্সা |
ভৈরব | সা | ঋা | গা | মা | পা | দা | না | র্সা |
আসারবী | সা | রা | জ্ঞা | মা | পা | দা | ণা | র্সা |
ভৈরবী | সা | ঋা | জ্ঞা | মা | পা | দা | ণা | র্সা |
মারবা | সা | ঋা | গা | ক্ষা | পা | ধা | না | র্সা |
পূরবী | সা | ঋা | গা | ক্ষা | পা | দা | না | র্সা |
টোড়ী | সা | ঋা | জ্ঞা | ক্ষা | পা | দা | না | র্সা |
বর্ণ :
স্বর বা গানের প্রত্যেক চলন বা ক্রিয়ার নাম বর্ণ। বর্ণ চার প্রকার। যথা: স্থায়ী, আরোহী, অবরোহী ও সঞ্চারী।
স্থায়ী :
একই স্বরের পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ স্বরে স্থিতির নাম স্থায়ী বর্ণ বলে পা পা পা
আরোহী :
ষড়জ স্বর থেকে সোজা ভাবে ওপরের নিষাদ স্বর পর্যন্ত উচ্চারণের ঊর্ধ্বগতিকে আরোহী বর্ণ বলে। যেমন- স র গ ম প ধন।
অবরোহী :
নিষাদ স্বর থেকে সোজাভাবে নিচের ষড়জ স্বর পর্যন্ত উচ্চারণের নিম্নগতিকে অবরোহী বর্ণ বলে। যথা: ন ধ প ম গ র স।
সঞ্চারী
স্থায়ী, আরোহী, অবরোহী এই তিনটি বর্ণের মিশ্রণকে সঞ্চারী বর্ণ বলে। যথা: স র গ র গ ম ম ম প ধ ন র্স ন ধ প ধ প ম গ ম গ র স।
অলংকার :
উপরিউক্ত চার প্রকার বর্ণসমূহের বিশিষ্ট রচনা পদ্ধতিকে অলংকার বলে। স্বরের বিচিত্র ও সুসংযত বিন্যাস যা ক্রমে ক্রমে উচ্চগ্রামে পুনরাবৃত্তি হয়ে রাগের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তাকে অলংকার বলে । সাধারণত অলংকার হলো সংগীত ও বাদ্যযন্ত্রকে নানানভাবে অলংকৃত করা- এ প্রকার অলংকার অনেক আছে। আপাতত অলংকারকে বর্ণ থেকে উৎপন্ন এবং উপরি উল্লিখিতভাবে বিশ্লেষণ করলেই চলবে। যথা সরগ র গ ম গ ম প ম প ধ ইত্যাদি।
রাগ :
ঠাট থেকে রাগের উৎপত্তি এবং একটি ঠাট থেকে বহু রাগ উৎপন্ন হতে পারে। স্বর, বর্ণ ও অলংকারাদিযুক্ত যে মনোরঞ্জনকারী সুর বিশেষ শ্রবণে চিত্ত প্রসন্ন হয় তাকে রাগ বলে। প্রতিটি রাগ বিশিষ্ট নিয়মিত স্বর বিন্যাসের দ্বারা রচিত। ঠাটের সর্বদা ৭টি স্বর থাকতে হবে কিন্তু রাগের ৭, ৬ বা ৫ স্বরও থাকতে পারে। রাগের মধ্যে কোনো স্বর একবারেই ব্যবহৃত না হলে তাকে বর্জিত স্বর বলে ।
রাগের জাতি :
ঠাট থেকে বিভিন্নভাবে স্বর সংখ্যা নিয়ে যে রাগের সৃষ্টি হয়েছে তাকে জাতি বলে।
“অর্থাৎ রাগের কয়টি স্বর আছে তা রাগের জাতি থেকেই বোঝা যায় ।
জাতি তিন প্রকার ঔড়ব, ষাড়ব ও সম্পূর্ণ জাতি।
ঔড়ব জাতি
যে রাগে একটি পূর্ণ ঠাট থেকে দুটি স্বর বর্জিত করে মাত্র ৫টি স্বরের দ্বারা রাগের পূর্ণতা প্রকাশ পায় তাকে ঔড়ব জাতি বলে।
ষাড়ব জাতি
যে রাগে একটি পূর্ণ ঠাট থেকে একটি স্বর বর্জিত করে ৬টি স্বরের দ্বারা রাগের পূর্ণতা প্রকাশ পায় তাকে ষাড়ব জাতি বলে।
সম্পূর্ণ জাতি
যে রাগে পূর্ণ ৭টি স্বর ব্যবহৃত হয় তাকে সম্পূর্ণ জাতি বলে।
এখানে এটা জেনে রাখা দরকার যে আরোহী ও অবরোহী উভয়ের সহযোগে জাতির উৎপত্তি। ৫টি স্বরের কমে রাগের উৎপত্তি হয় না। রাগের আরোহী ও অবরোহী বিচারের দ্বারা ৯ প্রকার জাতিকরণ হতে পারে। যথা:
১। সম্পূর্ণ – সম্পূর্ণ |
আরোহী |
অবরোহী |
২। সম্পূর্ণ – ষাড়ব |
৭টি স্বর |
৭টি স্বর |
৩। সম্পূর্ণ – ঔড়ব |
৭টি স্বর |
৬টি স্বর |
৪। ষাড়ব – সম্পূর্ণ |
৬টি স্বর |
৫টি স্বর |
৫। ষাড়ব – ষাড়ব |
৬টি স্বর |
৬টি স্বর |
৬। ষাড়ব – ঔড়ব |
৬টি স্বর |
৫টি স্বর |
৭। ঔড়ব – সম্পূৰ্ণ |
৫টি স্বর |
৭টি স্বর |
৮। ঔড়ব – সম্পূর্ণ |
৫টি স্বর |
৬টি স্বর |
৯। ঔড়ব – ঔড়ব |
৫টি স্বর |
৫টি স্বর |
রাগে “সা” বর্জিত হয় না। এ ছাড়া অন্য কোনো স্বর বর্জিত হতে পারে। কিন্তু একই রাগে মা ও পা একসঙ্গে বর্জিত হতে পারে না।
আরও দেখুনঃ