আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়ঃ সঙ্গীতের নাদ ও শ্রুতি। নাদ থেকে শ্রুতির উৎপত্তি। সুতরাং সকল শ্রুতিই নাদ কিন্তু সকল নাদই শ্রুতি নয়। আমরা যে সংগীত পদ্ধতির অনুসারী এই পদ্ধতির বিশেষজ্ঞগণ একজন সবল সুস্থ মানুষের সুখ শ্রবণ ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে শ্রুতি সংখ্যা নির্ধারণ করেছেন ২২টি। এই ২২ রকমের ক্ষতি থেকেই স্বরের উৎপত্তি।
নাদ ও শ্রুতি
গ্রহস্বর
প্রাচীনকালে সকল রাগের প্রারম্ভিক স্বরকে বলা হতো গ্রহস্বর। পরবর্তীকালে “সা” এখনও আমরা গ্রহস্বরকে যেকোনো রাগের প্রারম্ভিক স্বর বলতে পারি। কারণ, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই “সা” কিংবা ‘নি’ থেকে রাগের শুরু। যদিও অবশ্য এ সম্বন্ধে কোনো কড়াকড়ি নিয়ম নেই।
অংশশ্বর
যেকোনো রাগের সর্বপ্রধান স্বরকে বলা হয় অংশস্বর। কাজেই এই স্বরের গুরুত্বও যেমন অধিক তেমনি এই স্বরের ওপর জোরও দিতে হয় সবচেয়ে বেশি। আসলে “বাদী” এবং অংশস্বর সমার্থক শব্দ।

ন্যাস স্বর :
পূর্বে কোনো গানের আলাপের শেষ স্বর কিংবা উক্ত গানেরই শেষ স্বরকে বলা হতো ন্যাসম্বর। আজকাল ন্যাস স্বরকে রাগের প্রধান স্বর হিসেবেই ধরা হয়ে থাকে। অবশ্য যেকোনো রাগের প্রথম ন্যাসস্বরটিকে বানী এবং সম্বাদী বলেই ধরা হয়, কিন্তু একই রাগে এই দুটি ছাড়াও অপরাপর এক বা একাধিক স্বর প্রধান বলে বিবেচিত হতে পারে। আসলে এই ধরনের সবগুলো স্বরকেই কিন্তু ন্যাসশ্বর বলা হয়।
অপন্যাস স্বর
পূর্বে কোনো গানের আলাপের শেষ স্বর কিংবা উক্ত গানেরই খন্ডাংশের শেষ স্বরকে বলা হতো অপন্যাস স্বর। আজকাল অপন্যাস স্বরের ব্যবহার দেখা যায় না।
বক্রস্বর
যদি কোনো স্বর আরোহণ কিংবা অবরোহণ কালে কোনো নির্দিষ্ট স্বর পর্যন্ত গিয়ে সে স্বর পূর্ববর্তী স্বরে আবার ফিরে আসে, তাহলে উক্ত স্বরকে বলা হয় বক্রস্বর। যেমন প ধ ন ধ = ন বক্রস্বর হবে। র্স ন দ প ম গ ম র স = গ বক্রস্বর হবে ।
মীড় :
পরপর দুই বা ততোধিক স্বরের মধ্যবর্তী শ্রুতি বা সূক্ষ্মস্বর রয়েছে সেগুলোকে বলা হয় মীড়। সুরের মাধুর্য সৃষ্টিতে মীড়ের অবদান খুব বেশি। এক স্বর থেকে অন্য স্বরে যাওয়ার সময় সরাসরি প্রথম কিংবা পরবর্তী দ্বিতীয় স্বরে কণ্ঠকে থামিয়ে উভয় স্বরের মধ্যবর্তী শ্রুতিসমূহ বা সূক্ষ্ম স্বরগুলোকে কন্ঠে জড়িয়ে নেওয়াকে মীড় দেওয়া বলে। মীড় আসলে সুরের অলংকার। যে যে স্বরের মধ্যে। মীড় দিতে হবে সেগুলোর ওপর একটি বন্ধনী দিয়ে মীড়ের চিহ্ন নির্দেশ করা হয়। যথা: র ম র গ প মপ ক্ষম। উচ্চাঙ্গ, পল্লী প্রভৃতি সব রকমের গানেই মীড়ের বহুল ব্যবহার দেখা যায়।
কণ বা স্পর্শস্বর :
কোনো স্বর উচ্চারণ করার কিংবা বাজানোর সময় যখন অপর একটি স্বরের সামান্য ছোঁয়া দেওয়া হয় তখন এই শেষোক্ত স্বরকে বলা হয় কণ বা স্পর্শস্বর। স্পর্শস্বর একটা গোটা স্বরের সামান্য অংশমাত্র। আসলে এই অংশটুকু সুরের ক্ষণিক মাধুরিমা এবং প্রধান স্বরের ভূমিকারূপে এটুকু ব্যবহৃত হয় । তাই প্রধান স্বরের মাথার ওপর বা দিকে ক্ষুদ্রাকারে এটি লিখিত হয়। যেমন স্প রুণ বা স্পর্শস্বর ছাড়া স্বর আপন মাধুর্য হারিয়ে ফেলে এবং নিতান্ত সাদামাটা হয়ে পড়ে।
জনক ঠাট
ঠাট বা মেল থেকে রাগের উৎপত্তি। তাই অনেকগুলো রাগ এই ঠাটের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে । এই কারণে কেউ কেউ একে জনক ঠাট বলে থাকেন। (জনক মানে জন্মদাতা) জন্য রাগ। একই ঠাট থেকে যতগুলো রাগের উৎপত্তি হতে পারে সেগুলোকে বলে জন্য রাগ।
আশ্রয় রাগ
আশ্রয় রাগ সম্বন্ধে অবশ্য অনেক মতভেদ দেখা যায়। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায় যে, যে ঠাট থেকে রাগের উৎপত্তি হয়। সেই ঠাটের নামানুসারেই যদি রাগের নাম হয়, তাকে বলা হয় আশ্রয় রাগ, যেমন কাফী রাগ হলো কাফী ঠাটের আশ্রয় রাগ পণ্ডিত ভাতখন্ডে বলেন যে, যেকোনো জন্য রাগ গাওয়ার সময় মূল ঠাট থেকে উক্ত ঠাটবাচক রাগটির অল্পাধিক সাহায্য নিতে হয়। এই কারণে ঠাটবাচক রাগটিকে আশ্রয় রাগ বলাই সংগত

রাগ গাওয়ার সময় বা ক্ষণ
প্রত্যেক রাগ গাওয়ার সুনির্দিষ্ট সময় বা ক্ষণ নির্দেশ করা রয়েছে। সেজন্য দিন এবং রাতকে প্রধানত আট ভাগে ভাগ করা হয়েছে-
সকাল ৭টা থেকে সকাল ১০টা = ১ম প্রহর | সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা= ১ম গ্রহর |
সকাল ১০টা থেকে অপরাহ্ ১টা = ২য় প্রহর | রাত ১০টা থেকে মধ্যরাত ১টা = ২য় প্রহর |
অপরাহ ১টা থেকে বিকাল ৪টা = ৩য় প্রহর | মধ্যরাত ১টা থেকে ভোর ৪টা = ৩য় প্রহর |
বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা = ৪র্থ প্রহর | ভোর ৪টা থেকে সকাল ৭টা = ৪র্থ প্রহর |
নিম্নলিখিত বিষয়সমূহের প্রতি লক্ষ রেখে বিভিন্ন রাগ গাওয়া বা বাজানোর সময় নির্ধারণ করা হয়েছে
১। বাদীর স্থান
যদি বাদী স্বরসপ্তকের কিংবা রাগের প্রথম অংশে অর্থাৎ গোড়ার দিকে যেমন সা এবং মা মধ্যবর্তী স্থান থাকে তাহলে সেই রাগ মধ্যাহ্ন ও মধ্যরাত্রির অন্তর্বর্তী সময়ে অর্থাৎ বিকাল ও সন্ধ্যায় গেয়, যথা ইমন রাগ ইমনের বাদী স্বর গা। এই রাগকে বলা হয় পূর্ণরাগ বা পূর্বাঙ্গ রাগ কিন্তু যদি রাগের বাদী স্বরসপ্তকের তথ্য রাগের শেষ অংশে অর্থাৎ পা এবং নি’র মধ্যে থাকে তাহলে ঐ রাগ মধ্যরাত্রি ও মধ্যহ্নের অন্তর্বর্তী সময়ে অর্থাৎ ভোরে এবং সকালে গেয়। এই রাগকে বলা হয় উত্তর রাগ বা উত্তরাঙ্গ রাগ, যেমন ভৈরব রাগের বাদীস্বর কোমল দা।
২। বিকৃতস্বরের প্রাধান্য
(ক) যেসব রাগে কোমল রে (ঝ) এবং শুদ্ধ গা থাকে সেগুলোকে সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত কালে গেয় এদের বলা হয় সন্ধিপ্রকাশ রাগ। যেসব রাগে কোমল রে এবং শুদ্ধ গা ছাড়াও শুদ্ধ মা থাকে সেগুলোকে কেবল সূর্যোদয় কালে গেয়। কিন্তু যদি কোমল রে এবং শুদ্ধ গা ছাড়া তীব্র মা থাকে তাহলে সেগুলো কেবল সূর্যাস্তকালে গেয়
(খ) কোমল রে এবং শুদ্ধ গা বিশিষ্ট রাগের ঠিক পরেই শুদ্ধ রে এবং শুদ্ধ গা বিশিষ্ট রাগ গাওয়ার নিয়ম। কিন্তু আগেই বলা হয়েছে যে কোমল রে এবং শুদ্ধ গা বিশিষ্ট রাগ সকাল কিংবা সন্ধ্যায় গেয়। সময় বিভাগ আরও সুনির্দিষ্ট করার উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে যে, যে রাগের ‘মা’ শুদ্ধ সে রাগ সকালে অর্থাৎ সকাল ৭টা থেকে ১০টার মধ্যে গেয়। কিন্তু যেগুলোর মা তীব্র সেগুলো সন্ধ্যায় অর্থাৎ সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টার মধ্যে গেয়
(গ) যেসব রাগের গা কোমল সাধারণত সেগুলো উপরিউক্ত রাগসমূহের পরেই গাওয়ার নিয়ম ।
(ঘ) যেসব রাগের গা এবং নি কোমল সাধারণত সেগুলো ঠিক মধ্যাহ্ন কিংবা মধ্যরাত্রিতে গাওয়ার নিয়ম ।
(ঙ) যেসব রাগ সুনির্দিষ্ট সময়ে গেয়, যেমন- সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, মধ্যাহ্ন, মধ্যরাত্রি, সেগুলোতে প্রায়শ তত্ত্ব মা এবং তীব্র মা ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
৩। কতগুলো শুদ্ধ স্বরের প্রাধান্যঃ
(ক) যেসব রাগে শুদ্ধ রে, গা, ধা, নি রয়েছে সেগুলো সাধারণ সকাল কিংবা সন্ধ্যার প্রথম ভাগে গাইতে হয়। যেমন সকাল ৭টা থেকে ১০টা কিংবা সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত।
(খ) যেসব রাগ ঊষালগ্নে কিংবা গোধূলি লগ্নে গাওয়া হয় সেসব রাগে সা, মা, পা’র প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। যেমন ভোর ৪টা থেকে সকাল ৭টা কিংবা বিকাল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ।
(গ) গোধূলি লগ্নের রাগে কখনও গা এবং নি বর্জন করা হয় না। তেমনি উষালগ্নের রাগে কখনও রে এবং বা বর্জন করা হয় না।
৪। ঋতু রাগ
ঋতু রাগসমূহ আপন সুনির্দিষ্ট ঋতু অনুসারে দিনে কিংবা রাতে যেকোনো সময় গাওয়া যায়। যেমন বসন্ত ঋতুতে রাগ বসন্ত। অবশ্য সুনির্দিষ্ট ঋতুকাল ছাড়াও এগুলো গাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে উপরিউক্ত নিয়মাবলি অনুযায়ী রাগগুলো গাওয়ার সময় ক্ষণ নির্ধারণ করতে হবে। অবশ্য এ ব্যাপারে উপরিউক্ত নিয়মাবলি যে একদম অসহনীয় কিংবা অপরিবর্তনীয় এমন নয় ।

পূর্বাঙ্গ ও উত্তরাঙ্গ রাগ :
পন্ডিত ভাতখণ্ডের মতে যেসব রাগ মধ্যাহ্ন ও মধ্যরাত্রি অন্তর্বর্তী কালে গাওয়া হয়, সেগুলো পূর্বাঙ্গ রাগ এবং যেগুলো মধ্যরাত্রি ও মধ্যাহের অন্তবর্তী কালে গাওয়া হয় সেগুলো উত্তরাঙ্গ রাগ আসলে বাদীর স্থান বিবেচনা করেই পূর্বাঙ্গ রাগ নির্ধারণ করা হয়। পূর্বাঙ্গ রাগ সাধারণ স্বরসপ্তকের নিম্নস্তর সমূহে অর্থাৎ মন্ত্র (উদারা) এবং (মুদারা) স্বরগ্রামে গীত হয়, এবং পূর্ণতা লাভ করে। কিন্তু যদি বাদী স্বরসপ্তকের ওপরের দিকে অর্থাৎ মা, পা, ধা নি সা স্বরের মধ্যে থাকে তাহলে সেটা হবে উত্তরাঙ্গ রাগ। উত্তরাঙ্গ রাগ প্রধানত মধ্য (মুদারা) এবং তারা স্বরগ্রামে গীত হয় ও পূর্ণতা লাভ করে। অতএব, দেখা যাচ্ছে মা এবং পা পূর্বাঙ্গ ও উত্তরাঙ্গ উভয় রাগের অন্তর্গত দুটি সাধারণ স্বর।
বিস্তার
বিস্তার যেকোনো রাগের আরোহী ও অবরোহী একটি বিশেষ অঙ্গ রাগের স্বরলিপি ও অন্যান্য নিয়ম-কানুন রক্ষা করে স্বরকে উত্তরাঙ্গ কি না তার বিস্তার থেকেই তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলাপ ও তানের রাগের বিস্তার পরিপূর্ণতা লাভ করে।
সঞ্চারী
গানের তৃতীয় অংশ সঞ্চারী মন্ত্র (উদারা) ও মধ্য (মুদারা) সপ্তকে সুরের গতিবিধি প্রদর্শন করে।
আভোগ
গানের চতুর্থ বা শেষ অংশ। অন্তরার মতো এত মধ্য ও তার সপ্তকের স্বর বিন্যাস থাকে।
ধ্রুবপদ বা ধ্রুপদ :
‘ধ্রুব’ কথাটির অর্থ ‘নিশ্চিত’ বা ‘স্থিরিকৃত’। অতএব, স্বাভাবিক গতি বিশিষ্ট সুনিশ্চিত বা স্থিরিকৃত স্বরজনিত সংগীতকে বলা হয় ধ্রুবপদ বা ধ্রুপদ। এটি প্রাচীন ভারতের এক বিশেষ ধরনের উচ্চাঙ্গ সংগীত। এর আকার ও প্রকার যেমনি গুরুগম্ভীর তেমনি ভক্তি ও শাস্ত্র রসাশ্রিত। এর তাল স্থির ও অপরিবর্তনীয় সুরের বহু বিচিত্র বিস্তার ও সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে এই রাগ রূপায়িত হয়ে থাকে।
এই গান গাওয়ার জন্য মধুর ও উদাত্ত কণ্ঠের প্রয়োজন। এই গানের অন্য যেকোনো গানের মতোই চারটি অংশ রয়েছে, যথা: স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ। অবশ্য কোনো কোনো গানে দুটি অংশ দেখা যায়। ধ্রুপদে কোনো তান বা অলংকার থাকে না বটে, কিন্তু বিভিন্ন লয়কারী দুগুণ, তিনগুণ, চৌগুণ, লয়ে এই সংগীত গীত হয়ে থাকে। ধ্রুপদ চৌতাল, সুরফাঁক তীব্রা ইত্যাদি তালে গাওয়া হয়ে থাকে। পাখোয়াজই হলো ধ্রুপদের সঙ্গে বাজানোর সবচেয়ে উপযুক্ত বাদ্যযন্ত্র।
ধামার বা হোরী
ধামার বা হোরী গ্রুপদের মতোই খুব বনেদি ধরনের প্রাচীন সংগীত। এটি মৃদঙ্গের (পাখোয়াজের) সাথে ধামার তালে গাওয়া হয়। ধামার বা হোরী গানে শ্রীকৃষ্ণের গোপীলীলা ও বসন্ত ক্ষতুর বর্ণনা করা হয়। এটি সাধারণত ফাল্গুন মাসে ধ্রুপদী গায়কদের দ্বারা হয়, কারণ এই গানেও খুব মধুর ও উদাত্ত কণ্ঠের প্রয়োজন হয়। ধামার বা হোরী গানেও লয়, বাটের কাজ দুষণ, চৌগুণ ইত্যাদি মাত্রায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
টপ্পা
টপ্পা অতীব শ্রুতিমধুর এক ধরনের উচ্চাঙ্গ সংগীত। এটি শৃঙ্গাররস প্রধান ও চপল প্রকৃতির গান। কাফী, ভৈরবী, পিলু, দেশ, খাম্বাজ প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ রাগে, টম্পা তালে এই গান গীত হয়ে থাকে। টপ্পার দুটি ভাগ স্থায়ী এবং অন্তরা। এই গানের বোল বেশিরভাগই পাঞ্জাবি। অবশ্য বাংলা বোলেও অতি মনোরম বহু টপ্পা গান রয়েছে। পাঞ্জাব ও বাংলাদেশ ছাড়া বারানসীও টপ্পাগানের জন্য প্রসিদ্ধ। কঠিন বলে টপ্পাগানের প্রচলন ও লোকপ্রিয়তা খুবই কম। টপ্পাগানে সূক্ষ্ম ও জটিল স্বর ও বিশেষ বিশেষ তানের প্রয়োগ খুব বেশি। মোরী মিঞা টপ্পাগানের প্রবর্তক বলে জানা যায়।

ঠুমরি
ঠুমরি মধুর প্রকৃতির, চিত্তাকর্ষক, শৃঙ্গাররস প্রধান, লোকপ্রিয় এক ধরনের সংগীত । শিল্পনৈপুণ্য, সৌন্দর্যবোধ এবং রসসৃষ্টিকারী সৃজনিশক্তি ঠুমরি গানের প্রাণস্বরূপ। এটির দুটি অংশ স্থায়ী এবং অন্তরা।
ঠুমরি গানে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম স্বরবিন্যাস রয়েছে এবং সেইসব স্বরবিন্যাসের কাজ এত বেশি দরদ নিপুণতার সঙ্গে রূপায়িত করতে হয় যে, খুব উঁচুদরের গুণীদের পক্ষেও ঠুমরি গান গাওয়া সহজ নয়। ঠুমরি গান প্রধানত খাম্বাজ, দেশ তিলককামোদ, তিলং, কাফী, ভৈরবী, পিলু, ঝিনঝোঁটী, যোগীয়া ইত্যাদি। রাগে এবং ত্রিতাল, দীপচন্দী, যৎ ইত্যাদি তালে গাওয়া হয়ে থাকে।
মনে রাখতে হবে যে, হাচ্চা ধরনের গান হলেই তা ঠুমরি হয় না। ঠুমরির অঙ্গ দাদরা তালে আবার একে দাদরা গান বলা হয়। লক্ষ্ণৌ ও বারানসী থেকে উদ্ভূত পূরব সংগীত ঠুমরি নামে পরিচিত। এই গানের তান মৃদু, হাল্কা, শিল্পনৈপুণ্যযুক্ত রসসৃষ্টিকারী এবং ওজন মাফিক। “পূরব” ঠুমরির প্রধান বৈশিষ্ট্য এতে বিভিন্ন রাগের সংমিশ্রণে অপূর্ব রূপ, রস ও বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়ে থাকে। সবচেয়ে বড়ো কথা এর বোল ও বিস্তার অপূর্ব ও অনবদ্য।
প্রখ্যাত সংগীত বিশারদ সনদ এবং কদরপিয়া ঠুমরি গানের স্রষ্টা বলে জানা যায় ।
লয়কারী
একটি মাত্রাকে বিভিন্নরূপে ভাগ করাকে বলা হয় লয়কারী। যেমন- হাততালি দিয়ে তালের মাত্রা নির্দেশ করার সময় ছন্দের দোলনের সাথে দুবার তালি দিয়ে একটি মাত্রা নির্দেশ করা হয়। এখন এই দুই তালির মধ্যবর্তী সময়টুকুর মধ্যে যদি দুটি স্বর উচ্চারিত হয়, তাহলে এই দুটি স্বর দ্বারা একটি মাত্রা নিরূপিত হলো। তার মানে এক একটি স্বরকে বলা যেতে পারে অর্ধমাত্রা। অর্থাৎ দুটি অর্ধমাত্রা দ্বারা একটি পূর্ণমাত্রা নির্দেশ করা হলো। অতএব, দেখা যাচ্ছে যে মাত্রাংশের লয়কারী “ঠায়” লয়কে (বা স্বাভাবিক গতিছন্দকে) কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে।
নিম্নতালিকায় কতগুলো লয়কারীর স্বরূপ ও পরিচয় দেওয়া গেল।
আরও দেখুনঃ