সঙ্গীতে রাগের উপাদান

আজকে আমরা রাগের উপাদান সম্পর্কে আলোচনা করবো। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে রাগের বৈশিষ্ট্যগুলো সঙ্গীতকে শুধুমাত্র মাধুর্যের পর্যায়েই সীমাবদ্ধ রাখে না, বরং শ্রোতার মনে এক গভীর আবেগ তৈরি করে।

 

রাগের উপাদান

 

রাগের উপাদান

রাগের উপাদানগুলো হলো :

১। আরোহী ও অবরোহীঃ রাগে স্বর পর্যায়ক্রমে সর্বদা ব্যবহৃত হয় না, যেমন- স র গ ম র গ পন ধ ন র্স। রাগকে শ্রুতিমধুর করে তোলার জন্য সরাসরি বা মিশ্রভাবে হতে পারে। তবে প্রতিটি রাগের নিজস্ব নির্দিষ্ট নিয়ম (আরোহী-অবরোহী) আছে যা মানতে হবে।

২। ঠাট (যে ঠাট থেকে রাগের উৎপত্তি) যেসব বিকৃত স্বর রাগে ব্যবহৃত হয় সেগুলো থেকে প্রধানত ঠাট নির্ণয় করা যাবে।

৩। বিকৃত স্বর (যদি কোনো বিকৃত স্বর থেকে থাকে)। মধ্যম ছাড়া অন্য কোনো স্বরের শুদ্ধ ও বিকৃত পরপর এক রাগে ব্যবহৃত হবে না। যথা স র গ প দ ধ ন র্স।

৪। জাতি (বর্জিত) প্রত্যেক রাগে “সা” থাকবে। দুটি পরপর অবস্থিত স্বর বর্জিত হতে পারে না এবং মধ্যম ও পঞ্চমের মধ্যে একটি থাকা উচিত। পূর্বাঙ্গ ও উত্তরাঙ্গ মিলে অন্তত ৫টি স্বর থাকতে হবে।

৫। বাদী ও সম্মানী।

৬। অন্য বিশেষ স্বর যেমন- ন্যাস স্বর, গ্রহ স্বর, সঙ্গতি, বক্র স্বর, বহুত্ব ও অল্পত্ব ইত্যাদি।

৭। সময়

৮। বিস্তার

৯। প্রকৃতি

১০। পকড়।

 

google news
আমাদেরকে গুগল নিউজে ফলো করুন

 

পূর্বে আমরা প্রথম ৪টি উপাদান দেখেছি। এখন অন্যান্য উপাদানগুলো নিচে দেওয়া হলো। বাদী, অম্বানী, অনুবাদী, বিবাদী।

বাদী স্বর

রাগের মধ্যে যে স্বর সর্বপেক্ষা প্রধান অর্থাৎ অন্যস্বর অপেক্ষা অধিকরূপে ব্যবহৃত হয়ে রাগের প্রাণ সঞ্চার করে তাকে বাদী স্বর বলে। এ স্বরে স্থায়ী বিশ্রাম বা অন্য কোনোভাবে জোর দিয়ে প্রবল করানো যাবে। বাদী স্বরের অপর নাম অংশস্বর। এটা হল রাগের রাজার ন্যায়।

সম্বাদী স্বর :

রাগের মধ্যে যে স্বর প্রাধান্য বাদী স্বর থেকে কম, এবং অন্যান্য স্বর অপেক্ষা অধিক প্রয়োগ হয়, অথবা শ্রেষ্ঠ, তাকে সম্বাদী স্বর বলে। সম্বাদী হলো রাগের মন্ত্রীয় ন্যায়। সাধারণত সম্বাদী হলো বাদীর চতুর্থ বা পঞ্চম স্বরের নিচে বা উপরে যথা যদি বাদী রা হয়, সম্বাদী পা বা ধা হতে পারে; যদি বাদী গা হয়, সম্বাদী ধা বা না হতে পারে, এবং যদি বাদী মা হয়, সম্বাদী সা হবে।

অনুবাদী স্বর :

বাদী সম্বাদী ব্যতীত অন্যান্য ব্যবহৃত স্বরকে এ রাগের অনুবাদী স্বর বলে।

বিবাদী স্বর :

রাগের মধ্যে যে স্বর সাধারণভাবে প্রয়োগ হয় না অর্থাৎ যে স্বর ব্যবহার করলে রাগ ভ্রষ্ট হয় তাকে এ রাগের বিবাদী স্বর বলে। যাহোক, অনেক সময় অনেক সুগায়ক রাগের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য খুব ছোটো মাত্রায় বিবাদী ব্যবহার করে থাকেন কিন্তু বিবাদী স্বরের ব্যবহার খুব কঠিন তাই এ ক্ষেত্রে এটা এড়িয়ে চলাই শ্রেয়।

 

 

রাগের উপাদান

 

পকড়

রাগের বিশেষ স্বরের মাধ্যমে যার দ্বারা রাগ চেনা সম্ভব অর্থাৎ রাগ দর্শক মুখ্যস্বর সমূহকে পকড় বলে। পকড়কে রাগের অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদানও বলা হয়।

আলাপ :

স্বরকে রাগের যথার্থ সীমার মধ্যে রেখে ধীর ও স্বাধীনভাবে কণ্ঠ বা যন্ত্রে উচ্চারণ করাকে আলাপ বলে। অর্থাৎ রাগের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশক ভাব প্রধান স্বরবিন্যাসকে আলাপ বলে। আলাপে কোনো বিশেষ তাল ব্যবহার প্রয়োজন নয়।

শুধু লয় এবং ছন্দের ওপর গাইতে বা বাজাতে হয়। উচ্চাঙ্গ সংগীতে আলাপ অবশ্যই প্রয়োজনীয় এবং এ ছাড়া রাগের মূর্তির পূর্ণতা প্রকাশ পায় না। এক একটি স্বরকে মুখ্য বা কেন্দ্র স্থানে রেখে ক্রমশ মন্ত্র, মধ্য ও তার সপ্তক স্বরের প্রয়োগ করে রাগ রূপ প্রকাশ করতে হয়। গানের আগে বা মধ্যে আলাপ হতে পারে।

আলাপ তিন প্রকার আকার, সরগাম ও নোমতম নোমতম আলাপে “নেতে,” “তেরে, “তোম “তানা,” “নেরী, “নোম” প্রভৃতি শব্দের ন্যায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এরূপ আলাপ যা লয় এবং ছন্দের নিয়মে দীর্ঘ ৪টি অংশ বর্ধিত হয়; সেগুলো বিশেষভাবে ধ্রুপদ এবং ধামারের আগে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। গানের মধ্যে প্রত্যেক গানের অংশ নির্দিষ্ট আলাপ হতে পারে। এভাবে গানের কথা বাদ দিয়ে কেবল আকার (আ) বা সরগম যোগে ক্রমশ স্বরের কাজ করে রাগরূপ প্রদর্শন করতে হয় ।

বোল আলাপ :

আরও অগ্রগামী ও উন্নত ক্ষেত্রে গানের বোল আলাপ হতে পারে। সাধারণ আলাপের নিয়ম রক্ষা করে গানের কয়েকটি কথা সুন্দরভাবে রাগ অনুসারে ব্যবহার করাকে বোল আলাপ বলে ।

বাট

বাট এক রকম বোল আলাপ কিন্তু বিভিন্ন ছন্দে ও লয়ে নতুন নতুন মাত্রা বিন্যাসের মধ্যে ফেলে নানা রকম কাজ ও রচনা করাকে বাঁট বলে, যথা ২ বা ৩ মাত্রাযুক্ত গীতাংশকে একমাত্রার মধ্যে শেষ করে; অথবা ১ বা ২ মাত্রা লম্বা করে ৩, ৪ ও বেশি ছড়ায়। এটা হলো গণিত শাস্ত্র সম্বন্ধীয় ক্রিয়া। আলাপ অতি উচ্চাঙ্গ সংগীত ক্রিয়া ব্যবহারিক ক্ষেত্রে আলাপে এ সব ক্রিয়া আয়ত্ত করে প্রয়োগ করা বিশেষ কঠিন। কিন্তু সুশিক্ষা ও অভ্যাসের গুণে আলাপের স্তরবিন্যাস ক্রমেই সহজ হয়ে আসে।

 

রাগের উপাদান

 

তান :

স্বরকে দ্রুত লয়ে উচ্চারণ করাকে তান বলে: অর্থাৎ তাল, লয় ও ছন্দের সাহায্যে স্বর বিন্যাস যারা বিভিন্ন প্রকার গতিতে যাওয়া, আসাকে তান বলে, তান অর্থ হলো কণ্ঠ স্বরে উচ্চারণ করা: সুতরাং আলাপকেও তান বলা চলে।

তান সাধারণত তালের বিগুণ, তিনগুণ, চৌগুণ প্রভৃতি নিয়মের মধ্যে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্যদিকে আলাপ তানকে অনুসরণ করে না। সুতরাং রাগের রূপ এবং সৌন্দর্য আলাপ ও তান এ উভয়ের মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়ে থাকে।

স্বরমালিকা বা সরগম গীত

যেকোনো রাগের স্বরের সাহায্যে তালে, লয়ে, সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে রচনা করে গাওয়াকে সরগম গীত বা স্বরমালিকা বলে। এতে কেবল মাত্র সরগম থাকে, অন্য কোনো ভাষা থাকে না। এ গানের উদ্দেশ্য সংগীত শিক্ষার্থীর স্বর জ্ঞান ও রাগের জ্ঞান অর্জন করা।

লক্ষণগীত

শাস্ত্রীয়ভাবে তাল লয়ের সঙ্গে কোনো রাগ তার ঠাট বা মেল, জাতি, বাদী, সম্মানী, গাইবার সময়, রাগের রূপ ইত্যাদি বর্ণনার সমন্বিত গীতকে লক্ষণগীত বলে। এ গান সংগীত শিক্ষার জন্য সাহায্য দান করে।

 

রাগের উপাদান

 

খেয়াল :

উচ্চাঙ্গ সংগীতে খেয়ালও একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। মুসলমান যুগে মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহের রাজত্বকালে তাঁর দরবারে তৎকালীন প্রসিদ্ধ বীণকার গায়ক সদারঙ্গ ও আদারঙ্গের দ্বারা প্রচার হয়ে তা বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করেছিল। প্রসিদ্ধ শিল্পী আমীর খসরু খেয়াল গানের স্রষ্টা বলে কথিত আছে। তবে অনেক লেখক বলে থাকেন যে, সুলতান হোসেন শাহ এর প্রথম প্রচারক। এ সময় থেকেই খেয়াল সংগীতের সমঝদার বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয় খেয়াল গানে। শৃঙ্গার রসের প্রভাব সমধিক সৃষ্টি হয়। এতে রাগের স্বর বিন্যাস, স্বরালংকারের পরিপাট্য এবং তার গঠন-প্রণালি চিত্তাকর্ষক। এতে রাগের আলাপ, রাগ, বিস্তার, গমক, মীড় ইত্যাদি থাকলেও তানের প্রভাব সমধিক। খেয়াল দুই প্রকার বড় খেয়াল ও ছোট খেয়াল।

বড় খেয়াল 

বিলম্বিত লয়ের খেয়ালকে বড়ো খেয়াল বলে। এ সাধারণত একতাল, ঝুমরা, তিলুয়ারা আড়া চৌতাল ইত্যাদি তালে ধীরগতিতে হয়।

ছোট খেয়াল

মধ্য ও দ্রুত লয়ের খেয়ালকে ছোটো খেয়াল বলে। এ সাধারণত ত্রিতালে, মধ্য বা দ্রুতগতিতে গীত হয়ে থাকে। তান, সরগম তানের কাজ এতে সমধিক।

স্থায়ী

কোনো গানের প্রথম অংশ বারবার একইভাবে তাল এবং লয়ের সঙ্গে একই নিয়মে গীত 2 অংশকে স্থায়ী বলে। সাধারণত স্থায়ীর স্বরূপ মন্ত্র (উদারা) ও মধ্য (মুদারা) সা তে সীমাবদ্ধ থাকে। সংস্কৃত গ্রন্থের মতানুসারে গানের যে স্থান রাগ উপবেশন করে তাকে স্থায়ী বলে।

অন্তরা :

গানের দ্বিতীয় অংশকে অন্তরা বলে। এর স্বরূপ সাধারণত মধ্য সপ্তকের গা, মা, বা, পা থেকে উত্থিত হয়ে রাগ বিশেষে তার সপ্তকের মা বা পা পর্যন্ত গিয়ে পুনরায় মধ্য সপ্তকের স্থায়ীতে এসে মিলিত হয়।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment