বাঁশির গঠন নিয়ে আজকের আলোচনা। বাঁশী একটি শুষির যন্ত্র। বাঁশ থেকে তৈরী বলেই এই যন্ত্রের নাম বাঁশী। বর্তমানে বাশ ছাড়া পিতল, কাঠ, মাটি দিয়েও বাঁশী তৈরী হয়ে থাকে। বাঁশীর অনেক প্রকার ভেদ আছে- সরল বাঁশী, আড় বাঁশী, মুরলী বাঁশী, টিপরা বাঁশী, বেনু বাঁশী, লয়া বাঁশী, সানাই বাঁশী, ন্যাস তরংগ বাঁশী, শিংগা বাঁশী, রনশিংগা বাঁশী, শাখ, তুবড়ি বাঁশী ইত্যাদি রকমারী বাঁশী দেখতে পওয়া যায়।
বাঁশির গঠন
বাঁশি সাধারণত এক বিশেষ ধরনের বাঁশ দিয়ে তৈরি করতে হয়, যেগুলোর দুটো গাঁটের মাঝের অংশ অনেকটা লম্বা হয়। হিমালয়ের পাদদেশ থেকে ১১,০০০ ফিট উচ্চতায় পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে এই ধরনের বাঁশ প্রচুর জন্মায়। এই বাঁশ সাধারণত উত্তর-পূর্ব ভারত (অসম, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম ও ত্রিপুরা) এবং পশ্চিমঘাট পর্বতমালায় (কেরল) পাওয়া যায়, এসব অঞ্চলে বেশিরভাগ বাঁশের দু’ গিঁটের মাঝের উচ্চতা ৪০ সেমির (১৬ ইঞ্চি) বেশি হয়ে থাকে।
এই প্রাচীন এবং মনহরানো বাদ্যযন্ত্রের গায়ে সাতটি ছিদ্র (মাঝে মাঝে আটটিও ছিদ্র দেখা যায়) থাকে। যে নল বা পাইপটি দিয়ে বাঁশি তৈরি করা হয় তার একপাশ সম্পূর্ণ আটকে বায়ুরোধী করে দেওয়া হয়। বাঁশের তৈরি বাঁশিতে গিট বা গিরা একপাশকে বায়ুরোধী করার কাজে ব্যবহার করা হয়। বন্ধ এবং খোলা প্রান্তের মাঝামাঝিতে ছিদ্রগুলো করা হয়। যে ছিদ্রটি বন্ধ প্রান্তের ঠিক কাছাকাছি থাকে সেটা দিয়ে কৌশলে ফু দিতে হয় এবং বাকি ছযটি ছিদ্র ডান হাতের মধ্যবর্তী তিনটি এবং বাম হাতের মধ্যবর্তী তিনটি আঙ্গুল দিয়ে কখনো আটকে কখনো ছেড়ে দিয়ে সুর তুলতে হয়।
যে বাঁশগুলোর বেধ সাধারণ বাঁশির মতো হয়, সেগুলোকে প্রথমে শুকোনো হয় আর সোজা করার জন্য তেল কিংবা রেজিন মাখিয়ে রাখা হয়। এরপর শিল্পীরা বাঁশের গুণমান যাচাই করেন। ঠিক জায়গাগুলো চিহ্নিত করে বিভিন্ন ব্যাসের উত্তপ্ত লোহার শিঁক ঢুকিয়ে ছিদ্র করা হয়, কিন্তু ড্রিল করা হয় না। ফুঁ দেওয়ার ছিদ্র থেকে আঙুল রাখার ছিদ্রের দূরত্ব কিংবা ছিদ্রের ব্যাস নির্ধারণ করে বাঁশির স্বরের প্রকৃতি। আবার বাঁশের দেয়ালের স্থূলতা সুরের পাল্লা আর সপ্তকের মান নির্ধারণে দায়ী। এসব শেষ হলে বাঁশিকে তেলে চুবিয়ে, পরিষ্কার করে রেশম কিংবা নাইলনের সুতো দিয়ে সাজানো হয়।
ভারতে দু’ধরনের বাঁশি দেখা যায়– অনুভূমিক আর আড়াআড়ি বাঁশি। আড়াআড়ি বাঁশি অনেকটা হুইস্লের মতো করে ঠোঁটের ফাঁকে ধরতে হয়। লোকসংগীতেই এর ব্যবহার বেশি। অন্যদিকে অনুভূমিক বাঁশির গঠন জটিল, বাজানোও কষ্টসাধ্য― তাই কেবল শাস্ত্রীয় সংগীতেই এগুলো স্থান পেয়েছে।
বিভিন্ন রকম বাঁশি:
বাংলাদেশে সহ ভারত নেপালে বিভিন্ন রকম বাঁশীর দেখা যায়। তার মাঝে বহুলপরিচিত বাঁশী গুলো হলো:
সরল বাঁশি:
সরল বাঁশি মুখে পুরে সরাসরি বাজানো হয়। এই বাঁশিতে মুখের ছিদ্র ছাড়াও মুখের ছিদ্রের কাছে আরও একটি ছিদ্র থাকে যা বাঁশি বাজানোর সময় সুরের উপর প্রভাব ফেলে।
আড় বাঁশি:
বাংলায় আড় বাঁশির আরেক নাম মুরলী। আড় বাঁশির জনপ্রিয়তা সব থেকে বেশি। এই বাঁশিতে মোট ৭টি ছিদ্র থাকে এবং এটি আড়াআড়িভাবে মুখের সামনে ধরে শুষি দিয়ে বাজানো হয়। আড় বাঁশিতে আঙ্গুলের মাধ্যমে সুর নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
টিপরাই বাঁশি:
টিপরাই বাঁশিতে বাঁশির উপরের ছিদ্রে শুষি দিয়ে বাজাতে হয়। টিপরাই এর দুই পাশই উন্মুক্ত থাকে যে কারণে সবাই এই বাঁশি বাজাতে পারে না। বিশেষ কৌশলে এই বাঁশি বাজাতে হয়। টিপরাই দেখতে হয় নলের মতো।
সানাই বাঁশি:
দুই রিড যুক্ত বংশী শ্রেণীর লোকফুৎকার বাদ্য সানাই কাঠের তৈরি, যার এক প্রান্তে একটি ডবল রিড এবং অন্য প্রান্তে একটি ধাতু বা কাঠের ফ্লারেড ঘণ্টা থাকে এবং দেখতে অনেকটা ধুতুরা ফুলের মতো। ওপরের দিক চিকন নিচে দিক ক্রমশ চওড়া। লম্বায় দেড় ফুটের মতো। লোকবাদ্য সানাই বর্তমানে রাগসঙ্গীতযন্ত্র হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয়।
কদ বাঁশি:
কদ বাঁশি অনেকটা হুইসেলের মতো। এই বাঁশিতে ফু দেওয়ার ছিদ্র থাকে মাথায়। এতে ছয়টি করে ছিদ্র থাকে। বিভিন্ন এলাকায় কদ বাঁশি বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন – কলম বাঁশি, মুখা বাঁশি, খিলা বাঁশি ইত্যাদি।
তালপাতার বাঁশি:
গ্রাম অঞ্চলে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের এই বাঁশি বানিয়ে খেলা করতে দেখা যায়। পাতা পেঁচিয়ে শুষি দিলে একধরনের পোঁ পোঁ আওয়াজ হয়।
বাঁশির স্বরগ্রাম :
বাঁশিতে সংগীতের সাতটি স্বর (সা রে গা মা পা ধা নি) এবং পাঁচটি বিকৃত স্বর ( ঋ জ্ঞ ক্ষ দ ণ), সর্বমোট ১২ টি স্বরই পাওয়া যায় । বাঁশিতে সুর পরিবর্তন (টিউনিং) করা যায় না, তাই একজন বংশীবাদক কে ১২ টি স্কেলের ১২টি বাঁশিই সাথে রাখতে হয়।
উদারা সপ্তক এর পা ধা নি
মুদারা সপ্তক এর সবগুলো স্বর
তারা সপ্তক এর সা রা গা মা পা পাওয়া যায়
পা্ ধা্ নি্ সা রে গা মা পা ধা নি র্সা র্রে র্গা র্মা র্পা বাঁশিতে সাধারণত ৮টি ফুটো থাকে । একটি ফু দেবার জন্য ও ৬ টি সুরের জন্য । আর একটা থাকে কড়ি মধ্যম বাজানোর জন্য । বড় বাঁশির ক্ষেত্রে সেটি পা দিয়ে বন্ধ করে বাজানো হয় আর ছোট বাশির ক্ষেত্রে কনিষ্ঠা আঙ্গুল দিয়ে বাজানো হয় । বাঁশিতে “পা” ও “মা” স্বর দুটি বাজালে সপ্তক পরিবর্তন এর জন্য কাটা আওয়াজ আসে তাই পন্ডিত ভেংকাটেস গোদখিন্ডি পঞ্চম ছিদ্র (pancham hole ) এর আবিষ্কার করেন । এতে করে “পা” ও “মা” এর মধ্যেও মীড় করা সম্ভব হয় । তাছাড়াও কড়ি “মা” বাজানোর ছিদ্র ছাড়াও এখন একি যায়গায় শুদ্ধ “মা” ও শুদ্ধ “গা” বাজানোর জন্যও একের অধিক (২/৩) ফুটো করা থাকে ।
আরও দেখুন: