পর্ব ১: বাঁশির পরিচিতি
ইতিহাস অনুযায়ী, বিশ্বের প্রাচীনতম বাদ্য যন্ত্র বাঁশি। বিজ্ঞ্যানিরা বলেন, প্রায় ৬৭,০০০ বছর আগেই এমন যন্ত্র ছিল, যার আঁকার এবং বাজনার কৌশল আজকের বাঁশির সাথে মিলে যায়। সারা বিশ্বে, বাঁশির অগনিত ধরন আছে। মুলত, নলাকার, ফুঁ দিয়ে আওয়াজ বের করা যায় এবং সেই স্পন্ধন বা স্বর চাইলেই পরিবর্তন করা যায় এমন যন্ত্রগুলকেই সম্মিলিত ভাবে আমরা বাঁশি বলি। ফু দিয়ে বাজানো যায়, এমন সকল যন্ত্রকে এয়ারোফোনও বলা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, বাঁশির প্রাচীনতম রুপ পাওয়া যায় ইউরোপে।

[ পর্ব ১: বাঁশির পরিচিতি ]
মুলত, বিভিন্ন ধরনের হাড়ে, দুই থেকে চারটি ফুটা করে এই যন্ত্র বানানো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একই রকম বিভিন্ন সময়ের বাঁশির আবিষ্কার হলেও, বাঁশি একটি পরিনত বাদ্যযন্ত্র হওয়া শুরু করে ১৬ সতাব্দির রেনেসাঁর সময়। বিশ্বেজুড়ে বাঁশির আরো পরিনত রুপ গড়া এবং এর চর্চা শুরু হয় সেখানথেকেই। প্রতিটা আলাদা ধরনের বাঁশির বিশেষ নাম থাকলেও, প্রায় সব ভাসাতেই বাঁশির একটা নিজস্ব স্থানীয় নাম থাকে। যেমন বাংলায় বাঁশি, ইংলিশে ফ্লূট এবং হিন্দিতে বান্সুরি। হিন্দির এই বান্সুরি সব্দটি ইংরেজিতেও আছে, তবে সেটা শুধু আমাদের অতি পরিচিত বাঁশের বাঁশির ক্ষেত্রেই ব্যাবহার হয়। আমাদের অঞ্চলের বাঁশের বাঁশিই সারা বিশ্বে বান্সুরি/bansuri নামে পরিচিত। আজকের পরিচিতি এই বান্সুরি নিয়ে, যাকে আমরা বাঁশি বলেই সম্বধন করি।

এ অঞ্চলের বাঁশি এক পাশ থেকে ফু দিয়ে বাজাতে হয় দেখে একে “transverse flute” ও বলা হয়। ভারতবর্ষে ঠিক কবে এই ধরনের বাঁশির আবিষ্কার হয় তা সুনিশ্চিত না হলেও, এ অঞ্চলের প্রাচীনতম বইগুলতে বাঁশি/বেনুর গুরুত্তপর্ণ উল্লেখ পাওয়া যায়।
ইদানীংকালে ফাইবারগ্লাস, ধাতু এবং আরও বিভিন্ন রকম উপাদানের বাঁশি পাওয়া গেলেও, এর ঐতিহ্যগত রুপে এক ধরনের বিশেষ বাঁশ ই এই বাঁশি তৈরির মূল উপাদান। মূলত পাহাড়ি অঞ্চলে, যেখানে প্রচন্ড বৃষ্টি হয় সেসব যায়গাতেই এমন বাঁশ পাওয়া যায়। এ বাশগুলর এর প্রধান বৈশিষ্ট এর ব্যাস এবং গীড়োগুলোর দুরদত্ত, যা বাঁশির তৈরির জন্য উত্তম। ভারতের বিভিন্ন স্থানে এমন বাঁশ পাওয়া গেলেও হিমালয়ের বাঁশগুলোই এর মধ্যে সবথেকে প্রশংসিত। বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও এমন কিছু বাঁশ পাওয়া যায়, যা দিয়ে বাঁশি তোইরি করা হয়। সাধারনত বাঁশি তে ৬-৭ টা ফুঁটো থাকে যা দিয়ে আড়াই হেকে তিন সপ্তক স্বর বাজানো যায়। নতুন কিছু বাঁশিতে একটি অষ্টম ছিদ্র দেখা যায়, যা দিয়ে আরো কিছু সুরের কাজ করা হয়।

এই অঞ্চলে, কণ্ঠসংগীতকেই সংগীতের অন্যতম মর্যাদা দেয়া হয়। অনেকটা একারনেই, উপমহাদেশের মোটামুটি সব যন্ত্রই কন্ঠনির্ভর এবং সাধারনত এর স্বরের পরিসিমা কন্ঠের মতই তিন সপ্তক পার হয় না। এ অঞ্চলের সব যন্ত্রের শুরই বিভিন্ন খেত্রের সঙ্গতযন্ত্র হিসেবে। একক পরিবেশনার বিষয় হতে, যন্ত্রির সঙ্গে নাড়া বেধে প্রত্যেক যন্ত্রকেই একটা সংগ্রাম দিয়ে যেতে হয়েছে। বাঁশির খেত্রেও এর বাতিক্রম হয়নি।
বাঁশির আধুনিকরন এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের মূল ধারার যন্ত্রে পরিনত করার খেতাব পশ্চিম বঙ্গের পন্ডিত পান্নালাল ঘোষ কে দেয়া হয়। পান্নালাল ঘোষ বাবা আলাউদ্দিন খানের শিষ্য, তাই পান্নালাল ঘোশের বাদনশৈলী সেনিয়া মাইহার ঘরানার সাথে মিলে যায়। আধুনিক বাঁশির বেশ কিছু রূপই তার হাতে গড়া।
হিন্দুস্থানি উচ্চাং সংগীতে, ঘরানার একটি বিশেষ গুরুত্ত্ব আছে। বিভিন্ন ধরনের সংগীতের জন্যে বিখ্যাত ঘরানা রইলেও, আধুনিক বাঁশির খুব নতুন যন্ত্র হওয়ায় এর এখনও কোন বিশেষ ঘরানা না হয়ে, অন্যান্ন ঘরানার ধারা তে মিসে গ্যাছে। বিক্ষাত বংশিবাদক, যেমন নিত্যনান্দ হালদিপুর, হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, পান্নালাল ঘোষ সহ সিংহ ভাগই সেনিয়া মাইহার ঘরানার হয়ে বাজিয়ে থাকেন।
বাঁশি খুব জনপ্রিয় যন্ত্র হওায়, বিশ্বের প্রায় সব বাদ্যযন্ত্রের দোকানে এর দেখা পাওয়া যাবে, এই বিষয় সন্দেহ কম। খুব অল্প দামেই, যেকোন বাদ্যযন্ত্রের দোকান বাহ অনলাইন অর্ডারের মাধ্যমেই আপনি বাঁশি সংগ্রহ করতে পারেন। বাঁশির দাম সাধারত ১০ টাকা থেকে শুরু হয়ে ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত থাকতে পারে।
বিস্বজুড়ে শতাধিক বাঁশি বানানোর কারিগড় থাকলেও, কিছু “ব্রান্ড” আছে যারা তাদের বানানো বাঁশির জন্য বিখ্যাত। পুন্ম, কানহা, সারফুদ্দিন, হর্ষবর্ধন, ছাড়াও একটু ঘেটে নিলেই পাওয়া যাবে বাঁশির বর্তমান সব জনপ্রিয় ব্রান্ডগুলো। এদের প্রত্যেকেই নিজেদের “সিগ্নেচার” স্বরুপ বাঁশির উপরে বিভিন্ন ধরনের বুনন বা বাইন্ডিং করে রাখেন। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে, বাঁশির স্কেল এর সমাহার সব থেকে বেশিদের দলে। যেকোন স্কেলের বাঁশি কেনা গেলেও, একদমই নতুন শিক্ষার্থীদের ”G/G#/A#” স্কেলের বাঁশি কেনার পরামর্শ দেয়া যায়, কারন তা আকারে মাঝারি এবং শেখা তুলনামূলক সহজ।
বাঁশির পরিচিতি নিয়ে বান্সুরি গুরুকুলের প্রথম পর্বটিতে মুস্তাকীম আবীরের টিউটরিয়ালটি দেখার আমন্ত্রন রইল।
আরও দেখুন: