আজকে আমরা বাদ্যযন্ত্র বাঁশি নিয়ে আলোচনা করবো।
বাদ্যযন্ত্র বাঁশি । ড. আশরাফ সিদ্দিকী
শচীনদেব বর্মণ গীত একটি সুপরিচিত গান- “বাঁশি শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি/ সে যে দিন দুপুরে চুরি করে ঘরের নারীর মন রে।” বাঁশি এমনই “ডাকাতিয়া” যে তার মোহনীয় সুরে সুরে মন হয় উত্তলা- ঘরে নারীর মন বসে না…. ।
পল্লিগীতি সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের গীত সেই বিখ্যাত গান- প্রাণ সখীরে/ ঐ শোন কদম্ব তলায় বংশী ৰাজায় কে/ বংশী বাজায় কেরে সখী বংশী বাজায় কে/ আমার মাথার বেণী বদল দিয়া তারে আইনা দে/ যে পথ দিয়ে বাজায় বাঁশি/ যে পথ দিয়ে সে যায় / আমার নাকের কেশর খুইলা দিমু সেই না পথের গায়/ যেন জড়িয়ে পড়ে পায়…..
অন্য একটি গানে পাই- সেই সোনার বংশী বাদক যদি অন্য নারীর সঙ্গে বলে কথা/ তবে সে সায়রে ডুবে। পাষাণে ভাঙ্গিবে মাথা।
সে যুগের গ্রামোফোন কোম্পানির সৌজন্যে- এই পাগল করা বাঁশি নিয়ে এইরূপ বহু গানের রেকর্ড বের হয়েছিল- যা প্রায় দেশের প্রবীণ শ্রোতাদের সকলের জানা। বলা প্রয়োজন- রংপুরের এই সমাজ ছিল তখন মাতৃতান্ত্রিক; তাই নারীরাই এখানে প্রধান নায়িকা এবং গায়িকা ।
আমরা এই পাগল করা বাঁশি পাই চতুর্দশ শতকের বড়ু চণ্ডীদাস লিখিত “শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন” কাব্যেও । কেনা বাঁশি বড়াই কালিন্দী নই কূলে / কেনা বাঁশি বায়ে বড়াই এ মাঠ গোকুল /… বাঁশির শব্দে মোর আওলাইল রন্ধন…. ইত্যাদি। অর্থাৎ রাধা তার দাইমাকে জিজ্ঞেস করছে- কালিন্দী (যমুনা) নদীর কূলে কার বাঁশি বাজে; বৃন্দাবনের (গোকুল) মাঠেই বা কার বাঁশি বাজে… রাধার রন্ধন যে অগোছালো হয়ে গেল। মনে হয় শ্রীচৈতন্যের সময়ে বৈষ্ণব ধর্ম ও পদাবলী প্রসারের সঙ্গে কবি চণ্ডীদাস, কবি বিদ্যাপতি এবং আরও শত কবির আগমনে “শাস্তিহর ডুবু ডুবু নদে ভেসে যায়” শুধু কি নদে?- সমস্ত বাংলাই।
পদাবলীর মাধ্যমে বাঁশি বন্ধনা বিশেষ প্রসার লাভ করে। সে যুগে প্রবাদ ছিল- “রাধাকৃষ্ণ ছাড়া গীত হয় না।” তেমনই বাঁশি ছাড়াও গীত ছিল না। তাই প্রতিটি গানেই শ্রীকৃষ্ণ এখানে ‘মুরলীয়র’- তাঁর বাঁশির সুরে যমুনা উজান বয়। এর পূর্ব ইতিহাস- বিশেষ করে সেনদের শাসনামলের (দশম-দ্বাদশ অব্দে) গ্রন্থাদিতে বাশির উল্লেখ চোখে পড়ে না- এমনকি বৌদ্ধ যুগেও সম্ভবত ঢোল, মন্দিরা, খঞ্জনি, সামে এসবই ছিল সে যুগের গীত গানের অনুসঙ্গ।
আমরা “এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায়” পাই- সে যুগের ইউরোপে পিতল নিয়ে নির্মিত বাদ্যসামগ্রী ছিল- যা রাজরাজড়াদের সভামঞ্চে আগমন উপলক্ষ্যে রাজসভায় বাজানো হতো। চামড়ার তৈরি ঢোল সহযোগে কিন্তু তাতে আমাদের এ যুগের বাঁশের বাঁশির ছিদ্র সহ সন্ত সুরের কোনো বিবরণ নেই।
পরবর্তী যুগে সংগীতে সপ্ত সুর- সারেগামাপাধা-নি….. ইত্যাদির সঙ্গে গুণী বংশীবাদকদের মাধ্যমে এ সপ্ত সুর এসে যায়- যা ব্যতিরেকে রেকর্ড কোম্পানিও অন্যত্র কোনো গানের অনুষ্ঠানের সুরালাপই হতো না। আমাদের আদিবাসী সমাজে বাঁশির প্রচলন ছিল কিন্তু তাতে সপ্ত সুর ছিল না- এখনও নেই।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন গদ্য ও পদ্য রচনায় বাঁশির বর্ণনা রেখেছেন- বাঁশির করুণ ডাক বেয়ে/ ছেরা রাজছত্র মিলে চলে গেছে / এক বৈকুণ্ঠের দিকে… এ গান সত্য/অনন্য গোধূলী লগ্নে সেই খানে/…পরনে ঢাকাই শাড়ী/ কপালে সিঁদুর /… রাজপুরীতে সাঁজ বেলা শেষের তান গীতিমালা)।
অন্যত্র বাঁশিওয়ালা কবিতায় দেখি- ওগো বাঁশিওয়ালা বাজাও তোমার বাঁশি/… এমন সময়ে বাজে তোমার বাঁশি/ভয়া জীবনের সুরে/মরা দিনের নাড়ীর মধ্যে/দরদরিয়ে ফিরে আসে প্রাণের বেগ/ {শ্যামলী}।
রবীন্দ্রনাথের অজস্র গদ্য-পদ্যে ও নাটকে এই বাঁশির বর্ণনা আছে। শান্তিনিকেতনে প্রতিটি রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে বাঁশের এই বাঁশির ব্যবহার এবং “সংগীত ভবনে” বাঁশির সপ্ত সুরের তালিম দেওয়ার জন্য ছিল সুশিক্ষিত বংশীবাদক শিক্ষক।
আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুলের শতাধিক গানে এই বাঁশির উল্লেখ আছে- বিরহবিধুর কবি লিখেছেন- আজও মধুর বাঁশরী বাজে গোধূলী লগনে বুকের মাঝে……।
এই বাঁশি বাজানোর সঙ্গে নজরুলের করুণতম জীবনের এক কাহিনিও বিজড়িত। নজরুল লেটোর দলে থাকা কালেই সেই কিশোর বয়সেই বাঁশি বাজানো শিখেছিলেন- পরে যৌবনে বিভিন্ন বংশীবাদকদের মাধ্যমে তা আরও পরিপক্বতা লাভ করে। তিনি কলকাতা বা মফঃস্বল গেলে মনের আনন্দেই আপন খেয়ালেই বাঁশি বাজাতেন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি কলকাতার “ভারতীয় লাইব্রেরির” মালিক, লেখক, নাট্যকার, আলী আকবর খানের সঙ্গে আসেন তার আমন্ত্রণে কুমিল্লার গোমতী নদীর তীরে তাঁদের ছবির মতো গ্রাম দৌলতপুরে। এখানে যেমন গান গাইতেন, তেমনই বাঁশিও বাজাতেন মধুর সুরে- দিনে ও রাতে যা গ্রামবাসী- এমনকি গভীর রাতেও শুনে মুগ্ধ হতো- যার বিস্তৃত বর্ণনা আছে বুলবুল ইসলামের (প্রায়) “মেঘলামতীর দেশ”, “কুমিল্লায় নজরুল”, এম, এ, কুদ্দুস (প্রয়াত) লিখিত গ্রন্থে (১৯৬৪ থেকে ২০০১) এবং অন্যান্য লেখকের বিস্তৃত আলোচনায়ও।
তার প্রাণ চঞ্চলকারী বাঁশি শুনে শুধু গ্রামবাসী নয়- আরেক সুন্দরী কিশোরী সায়েদাবানু-যুবী-যুবরাজ যাঁর সঙ্গে পরে কবির দেওয়া নাম হয় “নার্গিস”- যিনি ছিলেন বন্ধু আলী আকবর খানের ভাগিনী- নজরুলের মাতাল করা বাঁশির সুরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেন। পরে তাদের শুভ পরিণয়ও সম্পন্ন হয় ৩রা আঘাঢ়, (১৩২৮)। কিন্তু দুর্ভাগ্য- নানা ভুল বোঝাবুঝির জন্য এই বিবাহটি স্থায়ী হয়নি। বেদনাবিধুর বিবরণ আছে নানা গ্রন্থে এবং নজরুলের অজস্র গানের মধ্যেও।
এখন ঢাকা এবং মফঃস্বলের বিভিন্ন সংগীত জলসা বা অনুষ্ঠানে এই বাঁশি অবশ্যই থাকবে- এমনকি নৃত্য-উৎসবে যাত্রা বা পালা গানেও।
আমাদের যাদের বাড়ি গ্রাম বাংলায় তারা যেখানে-সেখানে খেতে-খামারে গভীর রাতে এই প্রাণ চঞ্চলা করা বাঁশির সুরে সুরে উদ্বেলিত হয়েছি- যদিও তারা পেশাদার কোনো বংশীবাদক ছিল না।
সেই ত্রিশের দশক থেকেই কলকাতার বিভিন্ন রেকর্ড কোম্পানি বিশেষ জনপ্রিয়তা পায়। তার পরে অন্যান্য যন্ত্রসংগীতের সঙ্গে বাঁশিরও বেশ কিছু রেকর্ড হয়। কিন্তু দেশ বিভাগের পর ঢাকা শহর থেকে এমন প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছিল- এমন তথ্য আমাদের হাতে নেই।
সম্প্রতি উত্তম চক্রবর্তী বাঁশিকে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর একটি সিডিও বের হয়েছে ৷ তাঁর জন্ম স্থান টাংগাইল নাগরপুরে । গ্রামীণ বংশীবাদকদের বাঁশি শুনেই তিনি এই শিল্পে আকৃষ্ট হয়ে জড়িয়ে পড়েন। নাগরপুরের ছিল্লাবাজের মেলা থেকে বাঁশি কিনে শুরু করেন বাজানো। টাংগাইলে ওস্তাদ সানায়োর হোসেন, ওস্তাদ আব্দুল ওয়াহেদ, ঢাকায় শৈলেন বাড়ে, মরহুম ওস্তাদ আব্দুর রহমান, প্রয়াত দেবু ভট্টাচার্য এবং ব্যারিস্টার তৌফিক নাওয়াজ এবং বারী সিদ্দিকীর কাছে তালিম নিয়েছেন । উত্তম চক্রবর্তী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে সাফল ভূমিকা রেখেছেন। আমরা তাঁর আরও সাফল্য কামনা করি।
আরও দেখুনঃ